বয়স্কদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। যে মানুষটা ক্লান্তিহীনভাবে নিরলস কাজ করতে পারতেন অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতে পারতেন যে মানুষ, কয়েক পা সিঁড়ি ভাঙ্গতেই ক্লান্তিতে যেন ভেঙ্গে পড়েন নিজেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে শরীরে আসন গেঁড়ে বসে নানারকম রোগব্যাধি। দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘন ঘন প্র¯্রাব হওয়া, ঘুম কম হওয়া, ভুলে যাওয়া এগুলো পরিবারের বয়স্ক সদস্যেও ক্ষেত্রে অতি সাধারণ সমস্যা। সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে এই সাধারণ সমস্যাগুলোই হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। হয়রানি, অর্থের অপচয় ছাড়াও এই সাধারণ সমস্যাগুলোর কারণে মৃত্যুও হতে পারে প্রিয় মানুষটির। সময়মতো এসব রোগের রাশ টেনে ধরা জরুরি। আর তাই পরিবারের বয়স্ক মানুষটির নিয়মিত কিছু স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো আবশ্যক।

রক্তচাপ পরীক্ষা

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি তিনজন বয়স্কের ভেতর একজন উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে আক্রান্ত। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এর তথ্য অনুযায়ী, ৬৪ থেকে ৭৪ বছর বয়সের ভেতর যেকোনো সময় ৬৪ শতাংশ নারী এবং ৬৯ শতাংশ পুরুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে পারেন। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি এটি বুঝতেই পারেন না। ১৪০/৯০ মার্কারি বা এর বেশি রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান, কায়িক পরিশ্রম না করা, শরীরচর্চা না করা, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ, স্থূলতা, এমনকি বংশগত কারণের মতো নানা কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এ কারণেই বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে এই সাধারণ সমস্যাগুলোই হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।

দাঁতের পরীক্ষা

বৃদ্ধদের দাঁত পড়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সাধারণ একটি ঘটনা। শরীর যখন ঢলে পড়ে বার্ধক্যের দিকে, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে বাড়তে থাকে দাঁত ও মুখের জটিলতা। খাবার চিবোতে সমস্যা হয়। মাড়ির প্রদাহ বা পেরিওডোন্টাইটিসের প্রবণতা বেড়ে যায়। গবেষণা বলছে, বয়স্কদের মধ্যে ৪ শতাংশ মানুষ মাঝারি বা মারাত্মক পেরিওডোন্টাইটিস রোগে ভুগছেন। বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চুন-তামাক-জর্দা দিয়ে পান খাওয়া, নিয়মিত যতœ না নেওয়া প্রভৃতি কারণে দাঁতে সমস্যা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মুখে দুর্গন্ধ, দাঁতে ব্যথা, দাঁত নষ্ট হওয়া, পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ওরাল ক্যানসারের মতো মরণঘাতী রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বছরে অন্তত দু’বার ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া উচিত এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো জরুরি।

ডায়াবেটিস টেস্ট

অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের জন্যেই খুব সাধারণ একটি রোগ হচ্ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। অপরদিকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। তাই ৪৫ বছ বয়সের পর প্রতি বছর একবার ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং বা এওয়ানসি পরীক্ষা করা জরুরি। আর যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে তাদের নিয়মিত মাত্রা চেক করা প্রয়োজন।

হাড়ের পরীক্ষা

আন্তর্জাতিক অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মতে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে ৬৫ বছরের পর নারী পুরুষ প্রত্যেকেরই নিয়মিত হাড়ের পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।

থাইরয়েড ও হরমোন পরীক্ষা

অনেকসময় দেখা যায়, থাইরয়েডে সমস্যার কারণে শরীরের স্বাভাবিক মেটাবলিজম প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। অনেকসময় প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ফলে শরীর অতিরিক্ত মোটা বা চিকন হয়ে যায়, কর্মস্পৃহা লোপ পায় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হয়ে থাকে। টিএসএইচ পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড ও হরমোনের যাবতীয় জটিলতা নির্ণয় করা সম্ভব।

ত্বক পরীক্ষা

বাংলাদেশে ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই নিরাপদ থাকার জন্য প্রতিবছর অন্তত একবার ত্বক ক্যানসারের ঝুঁকি আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করা উচিত।

শ্রবণ পরীক্ষা

বয়স বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা কিংবা সংক্রমণের ফলে শ্রবণশক্তি কমে যায়। তাই প্রতি দুই থেকে তিন বছর অন্তর অডিওগ্রাম পরীক্ষা করা জরুরি।

ভ্যাকসিন নেওয়া

প্রতি দশ বছর পরপর টিটেনাসের টিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে যারা দীর্ঘদিন ধরে কোনো রোগে ভুগছেন তাদের বছরে একবার ফ্লু প্রতিরোধী টিকা এবং ৬৫ বছর বয়সের পর নিউমোনিয়ার টিকা এবং ৬০ বছরের পর দাদ ও খোসপাঁচড়ার টিকা নেওয়া উচিত।

চোখের পরীক্ষা

আমেরিকান একাডেমি অব অপথ্যালমলজির তথ্য অনুযায়ী, ৪০ বছর বয়সের পরেই মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। যদি আগে থেকে চশমা পরে থাকেন সেক্ষেত্রে প্রতি বছর একবার এবং যদি চশমা ব্যবহার না করেন তবে প্রতি দু বছর অন্তর চোখের পরীক্ষা করা উচিত।

কোলোরেক্টাল ক্যানসার টেস্ট

৫০ বছর বয়সের পর প্রতি দশ বছরে অন্তত একবার কোলনস্কোপি করা প্রয়োজন। তবে যদি কোলনে কোনো প্রকার পলিপ দেখা যায়, ভবিষ্যতে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ বোঝা যায় কিংবা পরিবারে কারো কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশ মোতাবেক মাঝে মাঝেই পরীক্ষা করানো উচিত।

প্রোস্টেট ক্যানসার স্ক্রিনিং

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ পুরুষদেরই প্রোস্টেট আকারে বড়ো হতে থাকে। অনেকেরই এর থেকে প্রোস্টেট ক্যানসার হতে পারে। রক্তে প্রোস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেনের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে কারো প্রোস্টেটের অবস্থা জানা যায়। চিকিৎসকেরা সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর পরীক্ষা করার জন্য বলে থাকেন। তবে পরিবারে প্রোস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে ৪০ বছর বয়সের পরই পরীক্ষা করা উচিত।

মেমোগ্রাম

৪৫ থেকে ৫৪, এই বয়সের ভেতর অন্তত একবার এবং এরপর প্রতি ২ বছরে একবার মহিলাদের স্তন ক্যানসার আছে কিনা কিংবা ঝুঁকি আছে কিনা সেটি জানতে মেমোগ্রাম করা যেতে পারে। তবে যদি পরিবারে কারো স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থেকে থাকে সেক্ষেত্রে প্রতি বছরই পরীক্ষা করা উচিত।

প্যাপ স্মেয়ার

৬৫ বয়সের পর অধিকাংশ নারীদেরই নিয়মিত পেলভিক পরীক্ষা ও প্যাপ স্মেয়ার করানো প্রয়োজন। প্যাপ স্মেয়ারের মাধ্যমে সাধারণ জরায়ু ক্যানসার নির্ণয় করা হয় এবং পেলভিক পরীক্ষার মাধ্যমে শ্রোণী সংক্রান্ত জটিলতা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

লিপিড প্যানেল

লিপিড প্যানেল টেস্টের মাধ্যমে সাধারণত রক্তে কোলেস্টেরোলের মাত্রা, এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাইগিøসারোয়েড ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। নিয়মিত লিপিড প্যানেল পরীক্ষা এবং তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হৃদরোগসহ অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

৪৫ থেকে ৫৪, এই বয়সের ভেতর অন্তত একবার এবং এরপর প্রতি ২ বছরে একবার মহিলাদের স্তন ক্যানসার আছে কিনা কিংবা ঝুঁকি আছে কিনা সেটি জানতে মেমোগ্রাম করা দরকার।
LinkedIn
Share
WhatsApp