বয়স্কদের হৃদরোগ: আতঙ্ক নয় সচেতনতা জরুরি

মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরই আলাদা আলাদা প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু হার্টের সঙ্গে অন্যগুলোর তফাৎ এই যে, অন্য কোনো অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ অসুস্থ হলে কিংবা অপসারণ করা হলে শুধু ওই অঙ্গের কার্যকলাপেই সমস্যা হয় এবং মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু হৃৎপিÐ ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। এই একটি অঙ্গের ওপরই বেঁচে থাকা, শক্তি, কর্মক্ষমতা সবই নির্ভরশীল। তাই হৃদয় ভালো থাকলেই মানুষ ভালো থাকবে, কর্মক্ষম থাকবে।

হৃদরোগের ধরন

হৃদরোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- জন্মগত, করোনারি, হার্ট ফেইলর, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, উচ্চরক্তচাপজনিত হৃদরোগ, কোর পালমোনাল বা হৃদপিণ্ডের ডান পাশ অচল হয়ে শ্বাস প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি হওয়া, সেরেব্রোভাস্কুলার বা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত, প্রান্তিক ধমনির রোগ, রিউম্যাটিক হৃদরোগ, যার ফলে বাতজ্বরের কারণে হৃদপিণ্ডের পেশি ও ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।

কেন হয় হৃদরোগ

হৃৎপিন্ড প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষে রক্তকণা পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি দেহের দূষিত রক্ত পরিশুদ্ধ করার জন্য ফুসফুসে সরবরাহ করে। বিভিন্ন কারণে হৃৎপিন্ডের এ স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হতে পারে। যেমন-

  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
  • বয়সজনিত কারণ। সাধারণত কমবয়সীদের তুলনায় বয়স্কদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • মহিলাদের মনোপজের পর হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • বংশগত কারণেও হৃদরোগ হতে পারে।
  • ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি রোগে ভোগা ব্যক্তিদের হৃদরোগের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি।
  • রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে।
  • অতিরিক্ত ওজন ও কায়িক পরিশ্রমের অভাব।
  • ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
  • শাকসবজি ও ফলমূল কম খাওয়া।
  • অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। যেমন- অসময়ে ঘুমানো, রাতজাগা, খুব বেশি বা একদমই কম ঘুমানো।
  • ধূমপান, মদ্যপান।


হৃদরোগের এ সকল কারণের মধ্যে গবেষকগণ মানসিক চাপের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেননা গবেষণায় রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ বা ধূমপানের অভ্যেস থাকার পরেও স্ট্রেস ফ্রি থাকার কারণে অনেকে যেমন হৃদরোগমুক্ত আছেন, তেমনি উপরের কারণগুলো না থাকার পরেও শুধুমাত্র স্ট্রেসের কারণেই অনেকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

হৃদরোগে আক্রান্ত কি না কীভাবে বুঝবেন

হৃদরোগের লক্ষণগুলো বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বুকে ব্যথা হয়ে থাকে। আর অধিকাংশ সময়ই আক্রান্ত ব্যক্তি এ ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটি ভেবে কালক্ষেপণ করে থাকেন।

হৃদরোগের কিছু লক্ষণ হচ্ছে-

  • বুকে বা বাহুতে ব্যথা। তবে শুধু বুকে ব্যথা হলেই হৃদরোগ বলা যায় না। বাহু, চোয়ালের পেছন দিক এবং গলায়ও চিনচিনে ব্যথা হতে পারে।
  • বুকে জ্বালাপোড়া করা
  • বদহজম, বমিবমি ভাব, অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস।
  • হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করে।
  • অনেক সময় রোগী ঘামতে থাকে। প্রবল শীতেও এমন হতে পারে। হৃদরোগ সব সময় হঠাৎ করে হবে এমনটা নয়। অনেক সময় হৃদরোগ ধীরে ধীরে মানুষের হৃদযন্ত্রকে বøক করে দেয়। এ ধরনের হৃদরোগকে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন’ বা হার্ট অ্যাটাক বলে। এক্ষেত্রে প্রবল অস্বস্তিকর অনুভ‚তি অন্যতম লক্ষণ।

প্রতিরোধ নাকি প্রতিকার

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ব্যক্তি নিজেই দায়ী থাকেন। কেননা শুধুমাত্র নিয়ম মেনে চললে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। তাই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই অধিক জরুরি। আর এটি প্রায় পুরোপুরিই প্রতিরোধযোগ্য। এ রোগ প্রতিরোধে বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। যেমন-

  • মানসিকভাবে চাপমুক্ত ও উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করুন।
  • ধূমপান, মদ্যপান ও মাদকদ্রব্য থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে মাদকাসক্তি নিরাময়ের চিকিৎসা নিন।
  • ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
  • প্রতিদিন কিছু সময় শরীরচর্চা করুন।
  • খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকুন।
  • প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
  • দৈনিক অন্তত আট ঘন্টা ঘুমান।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

রোগীর সার্বিক অবস্থা, পূর্বরোগের ইতিহাস এবং লক্ষণ দেখে প্রাথমিকভাবে যদি মনে হয় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে চিকিৎসক নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন।

  • কোলেস্টেরল ও ট্রাইগিসারাইডের পরিমাণ মূল্যায়নের জন্য রক্ত পরীক্ষা।
  • স্ট্রেস বা চাপ পরীক্ষা।
  • ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম।
  • ইকোকার্ডিওগ্রাম।
  • টিল্ট টেস্ট।
  • ইলেক্ট্রোফিজিওলজিক টেস্ট।
  • করোনারি এনজিওগ্রাম।
  • সিটি স্ক্যান বা কম্পিউটার টোমোগ্রাফি।

সাধারণত রোগীর শারীরিক অবস্থা ও রোগের ব্যাপ্তির ওপরই নির্ভর করে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা হবে। এক্ষেত্রে একেকজনের চিকিৎসা একেকভাবে হয়ে থাকে। কারো সার্জারির প্রয়োজন হয় আবার হৃদপিণ্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলোর কোনোটিতে বাধা দেখা দিলে মেটাল স্ট্যান্ট পরানো লাগতে পারে। কারো বাইপাস সার্জারি করতে হয় আবার কারো বুকে পেসমেকার বসানো হয়ে থাকে।

——————————————————————————————————————————————————

ডা. লুৎফর রহমান

এমবিবিএস, এমএস (সিটিএস)
চিফ কার্ডিয়াক সার্জন
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp