জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর কথা মনে আছে? ২০১২ সালে কোলন ক্যানসারে তিনি মারা যান। চিকিৎসার জন্য তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেছিলেন। সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পেতে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। ৬৩ বছর বয়সে যখন তাঁর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে, রোগটি তখন রীতিমতো চতুর্থ পর্যায়ে। অথচ, আগে তিনি তেমন কিছু টেরই পাননি। রোগটির ধরনই এমন। সর্বনাশের মুখোমুখি হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক সময় টেরই পাওয়া যায় না।
কোলন কী?
মানবদেহের খাদ্য পরিপাক এবং খাদ্যের যে নালিটি রয়েছে তার নিচের অংশকে বলা হয় কোলন বা বৃহদন্ত্র। এরও নিচের যে অংশে মল জমা থাকে তাকে বলে রেক্টাম। এই কোলন হয়েই রেক্টামের মাধ্যমে মল নিষ্কাশিত হয়। এর আগে কোলন শরীরের নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিন, পুষ্টিকর পদার্থ, লবণ এবং পানি শুষে নেয়। শরীরে প্রবহমান তরল পদার্থের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে কোলন।
কোলন ক্যানসার কী?
মলাশয়ের মিউকোসাল এপিথেলিয়ামের টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে পরিণত হলে তখন তাকে কোলন বা মলাশয়ের ক্যানসার বলে। এই ক্যানসার শুরু হয় বৃহদন্ত্রে অথবা কোলনের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত রেক্টাম বা মলনালিতে। ক্যান্সারটির উৎপত্তির স্থান মলনালিতে হলে এই কোলন ক্যানসারকে রেক্টাল ক্যানসারও বলা হয়।
কোলন ক্যানসার কেন হয়?
বংশগত: বংশে কারো কোলন ক্যানসার হয়ে থাকলে অন্যদেরও ঝুঁকি রয়েছে। পরিবেশগত: কোলন ক্যানসারের ক্ষেত্রে পরিবেশও দায়ী।
কোলন পলিপ: মলদ্বার বা মলাশয়ের ভেতরের দেয়ালে পলিপ্স জন্মায় যা শুরুতে বিনাইন টিউমার হিসেবে থাকলেও পরবর্তীকালে ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যেতে পারে।
খাদ্যাভ্যাস: অসম খাদ্যাভ্যাস কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। আঁশ জাতীয় খাবার কম খাওয়া এবং চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া এই ক্যানসারের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য: বেশি মাত্রায় কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা মানে বেশি সময় ধরে জীবাণুগুলো শরীরের সংস্পর্শে থাকা। ফলে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আলসারজনিত প্রদাহ: আলসার জনিত প্রদাহে যারা ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে এই ক্যানসার হবার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে ৩০ গুণ বেশি।
ধূমপান/ মদ্যপান: মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

লক্ষণসমূহ
- মলের সঙ্গে লাল বা গাঢ় লাল রঙের রক্ত দেখা যাওয়া।
- মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন।
- চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া-কোষ্ঠকাঠিন্য থাকা।
- মলত্যাগের পরও পেট পরিষ্কার হয়নি এমন মনে হওয়া।
- পেটে গ্যাস, পেট ফুলে থাকা, ফাঁপা ভাব, পেট মোচড়ানো ইত্যাদি কারণে পেটে অনবরত ব্যথা বা অস্বস্তি হওয়া।
- আশঙ্কাজনকভাবে ওজন কমে যাওয়া।
- মলাশয়ে ঘা।
ঝুঁকিতে রয়েছেন যারা
এই লেখাটির শিরোনাম ‘বয়স বাড়লে বাড়ে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি।’ এই শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় এই ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকার তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন বয়স্করা।

এর অর্থ কিন্তু এমন নয়- রোগটি কম বয়সীদের হবে না। তাদেরও হতে পারে। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। নিচের তালিকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন তো আপনিও আছেন কিনা সম্ভাব্য ঝুঁকিতে!
- যাদের অন্ত্রের কোনো অংশে পলিপ আছে।
- যাদের মলের সঙ্গে রক্ত যায়।
- যাদের উল্লেখযোগ্যভাবে মলত্যাগের অভ্যাসগত কোনো পরিবর্তন এসেছে।
- যারা শাক-সবজি-আঁশজাতীয় খাবার কম খান।
- যারা গরুর মাংস, ফাস্টফুড, বার্গার এসব খাবার বেশি খান।
- বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য আছে কি না।
- ওজন কমে যাচ্ছে কি না।
- ডায়াবেটিসের রোগী, যাদের ইনসুলিন রেজিস্টেন্স আছে।
এই তালিকায় যদি আপনি নিজেকে দেখতে পান, মুহূর্তমাত্র দেরি করবেন না। ডাক্তারের কাছে যান। সব কিছু খুলে বলুন। পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করুন।
মনে রাখবেন, এসব লক্ষণ থাকা মানেই এমন নয় যে আপনার কোলন ক্যানসার হয়েছে। বরং লক্ষণগুলো আপনাকে সচেতন হতে বলছে। আর শুরুতেই সচেতনতা আপনাকে রক্ষা করতে পারে অনেক অনাকাক্সিক্ষত জটিলতা থেকে।
আঁশজাতীয় খাবার কম খাওয়া এবং চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া কোলন ক্যানসারের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

ডা. এ.কে.এম. আহসান উল্লাহ
এমবিবিএস, এমএস (সার্জারি), এফসিপিএস (সার্জারি)
এমআরসিএস (এডিনবার্গ), এমআরসিএস (ইংল্যান্ড)
এ.টি.এল.এস কোর্স সার্টিফাইড (আমেরিকা)
প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি), জেনারেল ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ)
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার