ভাইরাল হেপাটাইটিস রকমফের

ভাইরাল হেপাটাইটিস রকমফের

অধ্যাপক ডাঃ সেলিমুর রহমান

লিভার আমাদের শরীরের সর্ববৃহৎ এবং অতীব প্রয়োজনীয় অঙ্গ। এর ওজন ১২০০-১৫০০ গ্রাম এবং এটি আমাদের শরীরের মোট ওজনের ৫০ ভাগের এক ভাগ। লিভারের মূল কাজ হলো শর্করা, আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাবার বিপাক, প্রোটিন ও এলবুমিন এবং রক্ত জমাট বাধার উপকরন উৎপাদন, পিত্তরস উৎপাদন, বিলিরুবিন ও বিভিন্ন ওষুধ বিপাক, ভিটামিন, আয়রন ও খনিজ পদার্থ জমা করা এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা।

ভাইরাল হেপাটাইটিস আমাদের দেশে একটি পরিচিত ব্যাধি। যদিও আমরা সাধারণভাবে ভাইরাল হেপাটাইটিসকে জন্ডিস বলে থাকি, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে জন্ডিস মানে কিন্তু ভাইরাল হেপাটাইটিস নয়। ভাইরাস ছাড়া জন্ডিস অন্য কারনেও হয়ে থাকে। যেমন পিত্তনালীর পাথর, প্যানক্রিয়াস ও পিত্তনালীর টিউমার। ভাইরাল হেপাটাইটিস সাধারণত হেপাটাইটিস এ,বি,সি,ডি ও ই ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। ভাইরাসগুলোকে সাধারণত আমরা দুভাগে ভাগ করে থাকি। হেপাটাইটিস এ ও ই পানি অথবা দূষিত খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢুকে থাকে। এছাড়া হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি রক্ত ও  রক্ত উপাদান গ্রহণ এবং সূঁচ অথবা সিরিঞ্জের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢুকে থাকে।

ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগের লক্ষণসমূহ

সাধারণত রোগী ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, কিংবা কোন কোন সময় বমি, শরীর ব্যথা, জ্বর জ্বর ও হলুদ রংয়ের চোখ ও প্রসাব নিয়ে আমাদের কাছে আসে। লক্ষণগুলো কোন কোন সময় এত অল্প থাকে যে, তা রোগীর নজর এড়িয়ে যায়। এছাড়া কোন সময় এমনও হতে পারে যে, রোগী রোগের শেষ পর্যায় যেমন, অবচেতন অবস্থায় আমাদের কাছে আসে।

রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাসমূহ

সাধারণত রক্তের দুটি পরীক্ষা করলে বুঝা যায় রোগীর হেপাটাইটিস আছে কিনা। যেমন রক্তের বিলিরুবিন ও এস জি পি টি। রোগীর রক্তে বিলিরুবিন ও এস জি পি টির মাত্রা সাধারণত বেশী পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে এস জি পি টির মাত্রা বেড়ে কয়েক হাজারও হয়ে থাকে। এছাড়াও যদি আমরা জানতে চাই কোন ভাইরাস দিয়ে হেপাটাইটিস হয়েছে তাহলে রক্তে ভাইরাসগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ নির্ণয় করা সম্ভব।

রোগের চিকিৎসা

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হালকা ভাবে আক্রান্ত রোগীকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা করা সম্ভব। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের পর রোগীকে বাসায় সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। রোগীকে বাসার তৈরী স্বাভাবিক খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। অতিরিক্ত বমি হলেও রোগী যদি মুখে একেবারে খেতে না পারে সে ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইনের পরামর্শ দেওয়া হয়।  লক্ষণগুলো প্রাথমিক অবস্থায় যত বেশী থাকে পরবর্তীতে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হয় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রোগী ৩ সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ  সুস্থ হয়ে উঠে। তবে রোগের মাত্রা যদি বেশী হয় এবং রোগীর অবস্থা যদি জটিল থাকে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে (শতকরা ৯০ ভাগ এর বেশী) রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী এমন জটিল হয়ে যায় যেটাকে আমরা লিভার ফেইলর বলে থাকি। সে ক্ষেত্রে রোগীকে আই সি ইউ তে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীর জীবনের ঝুঁকি থাকে এবং প্রয়োজনে উন্নত দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা করা হয়।

ব্যথার ওষুধ খাওয়া

যেহেতু রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর জ্বর, গা ব্যথা ও শরীর ব্যথা থাকে সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা ও জ্বরের জন্য ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল খাওয়ার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হলো প্রয়োজনে অল্প পরিমান প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। তবে বেশী পরিমান প্যারাসিটামল ও ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। অন্যান্য ওষুধ যেগুলো রোগী নিয়মিত সেবন করে সে ব্যাপারেও অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। 

রোগ প্রতিরোধে করণীয়

যেহেতু আমরা প্রথমে বলেছি যে, ভাইরাসগুলো আমাদের শরীরে দুভাবে ঢুকে থাকে সেহেতু প্রতিরোধের ব্যাপারটিও দুটি ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেমন হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের বিশুদ্ধ পানি ও বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়। পানি সম্ভব হলে ফুটিয়ে পান করা উচিৎ। এছাড়া বাইরের কাঁচা খাবার বিশেষ করে নিম্নমানের ফাষ্ট ফুড, ফুচকা, চটপটি, বিভিন্ন রকম শরবত যেমন আখের রস, লেবুর শরবত না খাওয়াই বাঞ্চনীয়। এছাড়া বাচ্চাদেরকে সম্ভব হলে হেপাটাইটিস এ এর ভ্যাকসিন নিতে হবে।

হেপাটাইটিস বি ও সি এর  প্রতিরোধে আমাদেরকে একবার (one time) ব্যবহারযোগ্য সিরিঞ্জ অথবা সূঁচ ব্যবহার করা উচিৎ। এছাড়া রক্ত অথবা রক্ত উপাদান গ্রহণের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। অবশ্যই  হেপাটাইটিস বি এবং সি পরীক্ষা করে রক্ত গ্রহণ করা উচিৎ। এছাড়া আমাদের দেশে ছেলেদের মোসলমানী (Circumcision), মেয়েদের নাক ও কান ফুটানোর সময় এবং দাঁতের চিকিৎসায় ও অন্যান্য শল্য চিকিৎসায় বিশুদ্ধ ছুরি কাঁচি এবং সূঁচ ব্যবহার করা উচিৎ। এছাড়া সব বয়সের নারী-পুরুষকে বি ভাইরাস প্রতিরোধে অবশ্যই হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ।

প্রসূতিকালীন সতর্কতা

প্রসূতিকালীন ভাইরাল হেপাটাইটিস আক্রান্ত রোগীর ব্যাপারে আমাদেরকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ প্রসূতিকালীন সময় ভাইরাল হেপাটাইটিসে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। প্রসূতি মা যদি হেপাটাইটিস বি অথবা সি তে আক্রান্ত থাকেন সে ক্ষেত্রে তার সন্তানকে হেপাটাইটিস থেকে রক্ষার জন্য অতিরিক্ত সাবধানতা এবং বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে জন্মের ১২ ঘণ্টার মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন (Immunoglobulin) দেওয়া জরুরি।

অপচিকিৎসা

আমরা প্রায়ই দেখে থাকি ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগীকে বিভিন্ন রকম অপচিকিৎসার শিকার হতে হয়। যেমন—হাত ধোয়ানো, মালা পড়ানো, বিভিন্ন রকম গাছের পাতা ও রস খাওয়ানো হয়। এ ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ, অবশ্যই এগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। এগুলো কোন উপকার তো করেই না বরং রোগীর মারাত্মক শারীরিক ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে এবং কখনো মৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়ায়। 


ডা. সেলিমুর রহমান

অধ্যাপক ডাঃ সেলিমুর রহমান

এমবিবিএস (ঢাকা), এফসিপিএস (মেডিসিন), এফআরসিপি
পোস্টগ্রাজুয়েট ফেলোশিপ ইন লিভার ডিজিজেস অ্যান্ড এন্ডোস্কপি (জাপান)
লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp