মস্তিস্কের রোগ আলঝেইমার

অধ্যাপক ডা. শাহরুখ আহমেদ

মুনিয়া রহমান। বয়স ষাটের কোটা পেরিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে পুরো সংসারটা একা হাতে সামলেছেন। বাচ্চা মানুষ করা থেকে স্বামীর খুঁটিনাটি। পাশাপাশি নিজের চাকরিটিও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করেছেন এই স্বনির্ভর নারী। সবকিছুই করেছেন সুনিপুণভাবে। একজন বিচক্ষণ, দক্ষ এবং সময়ানুবর্তী সফল নারী হিসেবে তিনি পরিচিত-মহলে বেশ সমাদৃত। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে একটা জটিল সমস্যায় ভুগছেন। হুটহাট ভুলে যাচ্ছেন সব। মিনিট দশেক আগের কথাটিও মনে রাখতে পারছেন না। এক কাপ চা বানাতে গিয়েও তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন ইদানীং। ফলে বিভিন্ন সময়ই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ছেন আজকাল।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুনিয়া রহমানের এই সমস্যাটির নাম ‘আলঝেইমার’। রোগটির সূত্রপাত হয় অত্যন্ত নিরীহভাবে। খুঁটিনাটি এটা-ওটা ভুলে যাওয়ার মতো স্বাভাবিকভাবেই এর যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে রূপ নেয় আলঝেইমারে। ফলে শুরুর দিকে অনেক সময়ই এই রোগটি ধরা পড়ে না।

আলঝেইমার কী

আলঝেইমার হচ্ছে মস্তিস্কের এক ধরনের রোগ। স্মৃতিভ্রংশের সাধারণ রূপ। এই রোগে আক্রান্ত রোগী কিছু মনে রাখতে পারেন না। আক্রান্ত ব্যক্তি স্মৃতিশক্তি, বিচারক্ষমতা, বিভিন্ন সামাজিক দক্ষতা হারাতে থাকেন। মস্তিষ্কের কোষগুলো সংকুচিত হতে হতে জট লেগে যায়। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি; এটি কিন্তু কেবল মাঝেমাঝে বিভিন্ন বিষয় ভুলে যাওয়াই নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু।

লক্ষণসমূহ

বর্তমান নিবন্ধের ভ‚মিকায় উল্লিখিত মিসেস মুনিয়ার সমস্যাগুলো থেকে আলঝেইমারের লক্ষণগুলোও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। তবে মস্তিষ্কের কোন অংশ আক্রান্ত, তার ওপরই রোগটির লক্ষণ নির্ভর করে। আর এজন্যই একেক আলঝেইমারের ক্ষেত্রে একেক রকম লক্ষণ দেখা যায়।

সাধারণ লক্ষণসমূহ

  • সাম্প্রতিক ঘটনা, নাম ও চেহারা ভুলে যাওয়া।
  • জিনিসপত্র ভুল স্থানে রাখা।
  • দিন-তারিখ বা সময় নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলা।
  • কথা বলার সময় যথাযথ শব্দটি মনে করতে না পারা। প্রয়োজনীয় শব্দটি কথাবার্তায় ব্যবহার করতে না পারা বা অন্যদের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
  • নিজের প্রয়োজন বা অনুভ‚তি অন্যকে যথাযথভাবে বোঝাতে না পারা।
  • কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
  • অল্প সময়ের মধ্যেই একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করা।
  • নতুন কোনো স্থান খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়া।
  • যখন তখন উদাসীন হয়ে যাওয়া এবং যেকোনো বিষয় বা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
  • অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যাওয়া। খিটখিটে আচরণ।
  • টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে না পারা।
  • সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে ওঠা।
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা।

কারণসমূহ

রোগটির সুনির্দিষ্ট কারণ এখন অবধি জানা যায়নি। তবে এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই অতিরিক্ত প্রোটিন মস্তিষ্কের কোষগুলোর স্বাভাবিক কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করে। মূলত জিনগত, জীবনশৈলী এবং পরিবেশগত অসংলগ্নতাকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা যায়।

যাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি

সব বয়সীদেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ৬০-৬৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষের মধ্যে রোগটি বেশি দেখা যায়।
তুলনামূলকভাবে নিম্নোল্লিখিত সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের আলঝেইমার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

  • যাদের স্ট্রোক হয়েছে।
  • যাদের ডায়াবেটিস আছে।
  • উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন যারা।
  • যাদের দেহে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল আছে।
  • যারা বিষণœতায় ভুগছেন।

চিকিৎসা

আলঝেইমারের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু অভ্যাস অনুশীলন করলে এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

  • নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে হৃৎপিÐের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রাও নির্ণয় করে নিন এবং তা উচ্চমাত্রার হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
  • ধূমপানের অভ্যাস থাকলে পরিহার করুন।
  • মদ্যপান পরিহার করুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • বিনোদনমূলক কাজকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিন।
  • মস্তিষ্ককে পছন্দের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখুন।
  • নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
  • আরামদায়ক মালিশ বেশ ফলদায়ক।
  • পর্যাপ্ত শাকসবজি ও ফলমূলসমৃদ্ধ সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • কাজে ব্যস্ত থাকুন। দীর্ঘসময় কাজহীন অলস সময় কাটাবেন না।

——————————————————————————————————————————————————

অধ্যাপক ডা. শাহরুখ আহমেদ

এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (নিউরোলজি)
নিউরোলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp