মাথার ত্বকের নানা রোগ

মাথার ত্বকের নানা রোগ

-ডা. ইসরাত জাহান

একটি কর্পোরেট অফিসে নয়টা-পাঁচটা চাকরি করেন চল্লিশোর্ধ্ব সামিয়া। সংসার, সন্তান, অফিস সবকিছু সামলে নিজের যত্নের জন্য সময় বের করতে পারেন না তিনি। আগে একরাশ কোঁকড়া চুল ছিল তার। ধীরে ধীরে চুল পড়ে পাতলা হয়ে গেছে। খুশকির সমস্যা আগে থেকেই ছিল। ইদানীং সেটি তীব্র আকার ধারণ করেছে। মাথার ত্বকের কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে। মাথার ত্বক খুশকির সঙ্গে টুকরা হয়ে উঠে আসছে। ফলে কিছু অংশে ক্ষত তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পরামর্শের জন্য যান। চিকিৎসক জানান, তার এই সমস্যাটির নাম সেবোরিক ডার্মাটাইটিস (Seborrheic Dermatitis)। এটি একধরনের চর্মরোগ, যা মূলত ত্বকের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়ে থাকে।

মাথার ত্বকের নানা রোগ

মাথার ত্বকের যত রোগ

মাথার ত্বকের সুস্থতার ওপর চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। তাই মাথার ত্বকে কোনো রোগ বা সংক্রমণ হলে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। অনেকসময় ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে মাথার ত্বকে সংক্রমণ দেখা দেয়। এছাড়া দেখা দেয় নানা ধরনের চর্মরোগ। মাথার ত্বকে যে রোগগুলো বেশি হতে দেখা যায় তা নিম্নরূপ—

মাথার ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণ : গরমে মাথার ত্বক ঘেমে ও ধুলাবালু জমে ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়। এর ফলে স্ক্যাল্প বা মাথার ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি, ব্যথা, জ্বলুনি হতে পারে। অনেকসময় চুলকাতে চুলকাতে ঘা কিংবা অ্যাকজিমাও হতে পারে। সাধারণত তিন থেকে চার ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণে এমনটা হতে দেখা যায়।

মাথার ত্বকে সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত গোসল করা ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি। অনেকসময় সাধারণ সাবান বা শ্যাম্পুসহ নিয়মিত গোসলেই এটি সেরে যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা শ্যাম্পু ব্যবহারের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

খুশকি : মাথার ত্বকে সিবাম নামক একধরনের তেল নিঃসৃত হয়, যা চুলকে মসৃণ ও সুন্দর রাখে। অন্যদিকে মাথার ত্বকের গোড়ায় বসবাস করে মেলাসিজিয়া নামক একধরনের ছত্রাক। মেলাসিজিয়া এই সিবামের কিছু অংশ খেয়ে বেঁচে থাকে। তেলের যে অংশ মেলাসিজিয়া খায় না, তা জমাট বেঁধে মাথার ত্বক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে চায়। ফলে মাথার ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের নিচে নতুন ত্বক তৈরি হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক খসে যায়।

এটিই ড্যানড্রাফ বা খুশকি নামে পরিচিত। যাদের মাথার ত্বক তৈলাক্ত তাদের খুশকি বেশি হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিটোকোনাজল শ্যাম্পু ও অন্যান্য চিকিৎসার মাধ্যমে খুশকিমুক্ত থাকা যায়।

সেবোরিক ডার্মাটাইটিস : এটি খুশকির একধরনের জটিল রূপ। খুশকি আরও তীব্র আকার ধারণ করলে, মাথার ত্বক লাল ও ক্ষতের মতো হয়ে গেলে, ত্বক টুকরার মতো উঠে এলে, তাকে সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বলে। মাথার ত্বক অতিরিক্ত তৈলাক্ত হলে এই সমস্যা বেশি হয়। শুধু মাথার ত্বক নয় ভ্রু বা মুখের ত্বকেও সেবোরিক ডার্মাটাইটিস হতে পারে।

রিং ওয়ার্ম : এটি একধরনের ছত্রাকজনিত সংক্রামক চর্মরোগ। এতে মাথার ত্বকের কিছু অংশ থেকে গোল হয়ে ছোপ ধরে কিছু চুল উঠে আসে। শিশুদের মাথার ত্বকে ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে এটি বেশি হতে দেখা যায়। যেহেতু এটি সংক্রামক তাই আক্রান্ত ব্যক্তির তোয়ালে, টুপি, হ্যাট ইত্যাদি ব্যবহার করলে অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। এ সমস্যা দূর করতে ছত্রাকরোধী মলম ও ওষুধ ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।

ফলিকুলাইটিস : আমাদের চুলের ফলিকল থাকে মাথার ত্বকে। সেখান থেকেই চুল গজায় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়ে। চুলের গোড়ায় বা ফলিকলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে তাকে ফলিকুলাইটিস বলে। এতে মাথার ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় পুঁজভর্তি ছোটো দানা হয়। শেভ বা ওয়াক্স করার কারণেও এমনটা হতে পারে। এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।

সোরিয়াসিস : সোরিয়াসিস অত্যন্ত জটিল একটি রোগ। অনেকেই এটিকে খুশকি মনে করেন। কিন্তু খুশকি আর সোরিয়াসিস দুটো আলাদা রোগ। এই রোগে মাথার চামড়া মোটা হয়ে যায়। শুরুতেই স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। তবে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।

শুষ্ক চুল ও ডগা ফাটার সমস্যা : ভিটামিন-এ, প্রোটিন, আয়রন, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, জিংক আমাদের মাথার ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শরীরে এই পুষ্টি উপাদানগুলোর যেকোনো একটির অভাব দেখা দিলেই চুল শুষ্ক হয়ে যেতে পারে এবং চুলের ডগা ফাটার সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে জরুরি নিয়ম-কানুন

মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে যেসব বিষয় মাথায় রাখবেন—

  • মাথার ত্বকের ধরন বুঝে তেল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ও অন্যান্য প্রসাধনী ব্যবহার করতে হবে।
  • পরিবেশ দূষণজনিত মাথার ত্বকের সমস্যা এড়াতে চুল খোলা রেখে বাইরে বের হবেন না। স্কার্ফ বা ক্যাপ ব্যবহার করুন।
  • মাথার ত্বক তৈলাক্ত হলে রোজকার ব্যবহারে এমন শ্যাম্পু বেছে নিতে হবে যা মাথার ত্বক গভীরভাবে পরিষ্কার করে।
  • স্বাভাবিক ও শুষ্ক মাথার ত্বকের জন্য প্রযোজ্য হিসেবে চিহ্নিত প্রসাধনী ব্যবহার করুন। শ্যাম্পু ব্যবহার করুন তিন-চার দিন অন্তর।
  • চুলে অ্যামোনিয়াযুক্ত কোনো রং বা প্রসাধনী ব্যবহার করবেন না।
  • বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারো পরামর্শে চুলে হেয়ারপ্যাক বা তেল ব্যবহার করবেন না।
  • মাথার ত্বকের যেকোনো সমস্যায় অবহেলা করবেন না।
  • প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খান।
  • নিয়মিত দুধ বা দুধজাতীয় খাবার খান।
  • দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিন্ত করুন।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

ডা. ইসরাত জাহান

ডা. ইসরাত জাহান

এমবিবিএস, (সিএমসি), ডিসিডি, এমএসসি (যুক্তরাজ্য)
ডার্মাটোলজিস্ট এস্থেটিক্‌স অ্যান্ড লেজার স্পেশালিস্ট
চেম্বার : ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক্‌স
গুলশান-২

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp