মেছতা কেন হয় : সমাধানে কী করবেন

মেছতা কেন হয় : সমাধানে কী করবেন

ডা. ইসাবেলা কবির

সদ্য সন্তানের মা হয়েছেন মিরা। বাচ্চাকে দেখতে এসে প্রত্যেকেই মিরার গালের কালো দাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন করছেন। পরিষ্কার ত্বক ও সুন্দর মুখশ্রীর কারণে পরিচিতমহলে একসময় বেশ নামডাক ছিল তার। কিন্তু গর্ভধারণের কিছুদিন পর হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন, তার নাকের দুই পাশ থেকে গাল অব্দি ছোপ ছোপ কালো দাগ দেখা দিয়েছে। ধীরে ধীরে দাগ আরো স্পষ্ট হতে শুরু করে। বর্তমানে ত্বকের এই দাগ এবং সবার নানা জিজ্ঞাসায় বেশ বিব্রত মিরা।

মেছতা কেন হয় : সমাধানে কী করবেন

মিরার দুশ্চিন্তা দেখে তার স্বামী তাকে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক মিরার ত্বকের দাগ দেখে জানান, তার ত্বকে দেখা দিয়েছে মেলাসমা বা মেছতা। মিরার এই মেছতা গর্ভকালীন, তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। অনেকেরই গর্ভকালীন মেছতা হতে দেখা যায়। চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে এই দাগ দূর করা সম্ভব।

মেছতা কী?

মেলাসমা বা মেছতা ত্বকের একধরনের পিগমেন্টেশন ডিসঅর্ডার বা ত্বকের রোগ। মূলত ত্বকের রঞ্জক পদার্থ মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই এর কারণ। বংশগত কারণ, অতিরিক্ত সূর্যালোক, জন্মনিরোধক বড়ি সেব, শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে মেলানিন বেড়ে যায়। ফলে মুখ, থুতনি, কপাল ও গালে হালকা বা গাড় বাদামি রঙের দাগ দেখা দেয়। দিন যত যায় তত গাঢ় হয় এই দাগ। নষ্ট করে দেয় ত্বকের সৌন্দর্য। এতে বেড়ে যায় রোগীর দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ। সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগটি বেশি হতে দেখা যায়। তবে পুরুষদের ত্বকেও মেছতা হতে পারে।

কেন হয় মেছতা?

মেছতার প্রকৃত কারণটি এখনো অজানা। তবে ধারণা করা হয়, বংশগত কারণের পাশাপাশি যারা বেশি সময় সূর্যালোকে থাকেন, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। অনেকেরই গর্ভধারণের সময় হরমোনের প্রভাবে ত্বকে মেছতা দেখা দেয়। তাই মেছতাকে ‘মাস্ক অব প্রেগনেন্সি’ বলা হয়। আবার অতিরিক্ত প্রসাধনী ব্যবহারের কারণে মেছতার মতো হতে পারে। যকৃতের জটিলতার কারণেও মেছতা হয়। মেছতার কারণে ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়। অনেকেই মুখে, গালে মেছতার কালো দাগ নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। সবচেয়ে বেশি যে কারণগুলোকে মেছতার জন্য দায়ী বলা হয়—

  • বংশগত কারণ
  • সূর্যের আলোর প্রভাব
  • জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন
  • গর্ভধারণ করা
  • থাইরয়েডজনিত সমস্যা
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • তীব্র মানসিক চাপ
  • যকৃতের সমস্যা
  • মেনোপজ
  • হরমোনজনিত সমস্যা
  • অতিরিক্ত প্রসাধনী ব্যবহার

মেছতার চিকিৎসা

মেছতা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে— এপিডারমাল মেলাসমা, ডারমাল মেলাসমা ও মিক্সড। ত্বকের ওপরের অংশে যে মেছতা হয়, তাকে বলে এপিডারমাল মেলাসমা। আর ত্বকের ভেতরের অংশে যে মেছতা হয় তাকে বলা হয় ডারমাল মেলাসমা। এই দুইয়ের বৈশিষ্টযুক্ত মেছতাই হচ্ছে মিক্সড মেলাসমা। এপিডারমাল মেলাসমার চিকিৎসা সহজ হলেও ডারমাল মেলাসমার চিকিৎসা বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে ধৈর্যের বিকল্প নেই।

মেছতা কেন হয় : সমাধানে কী করবেন

তবে গর্ভকালীন মেছতা হলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সন্তান জন্মের পর ধীরে ধীরে এটি চলে যায়। মেছতার চিকিৎসা প্রাথমিক অবস্থায় শুরু করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। ২ হাইড্রোকুইনোন ত্বকে লাগালে উপকার হতে পারে। এছাড়া ট্রেটিনয়েন, গ্লাইকোলিক অ্যাসিড, কোজিক অ্যাসিড ইত্যাদিও ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে কেমিক্যাল পিলিং, মাইক্রোডার্মাব্রেশন ও পিআরপি থেরাপির মাধ্যমে মেছতার চিকিৎসা করা হচ্ছে। এছাড়া মেছতার চিকিৎসায় এজেলিক অ্যাসিড, ট্রানেক্সামিক অ্যাসিড ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়।

অনেকেই এগুলোকে ক্রিম মনে করে নিজের ইচ্ছামত কিনে ব্যবহার করেন। মনে রাখতে হবে এগুলো ক্রিম নয়, ওষুধ। তাই ত্বকে এসব ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে।

মেছতা প্রতিরোধ

নানা কারণে ত্বকে মেছতা হতে পারে। তাই মেছতা প্রতিরোধে এর সম্ভাব্য কারণগুলো বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। মেছতার অনেক বড়ো একটি কারণ মনে করা হয় তীব্র সূর্যালোক ও চুলার আঁচে দীর্ঘসময় অবস্থান করা। তাই সূর্যের আলোতে বাইরে গেলে এবং রান্না করার আগে ত্বকের উন্মুক্ত অংশে ভালোভাবে সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিতে হবে। বাইরে ছাতা ব্যবহার করতে হবে। সানস্ক্রিনের ক্ষেত্রে উচ্চ এসপিএফযুক্ত সানস্ক্রিন বেছে নিতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের সমস্যা আছে কী না তা শনাক্ত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ঠিক না হলে মেছতা বারবার ফিরে আসে। তাই এর কারণগুলো দূর করতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। নিয়মিত ফলমূল ও শাক সবজি খেতে হবে। যথাসম্ভব সূর্যালোক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন।


ডা. ইসাবেলা কবির

ডা. ইসাবেলা কবির

এমবিবিএস, এমসিপিএস, এফসিপিএস
ফেলো ইন কিউটেনাস অ্যান্ড লেজার সার্জারি (থাইল্যান্ড)
চর্ম, যৌন, কুষ্ঠ, সেক্স, অ্যালার্জি ও স্কিন লেজার বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp