ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি: এড়াবেন কীভাবে
বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ম্যালেরিয়ার বিস্তার মূলত আফ্রিকান অঞ্চলে বেশি। তবে বাংলাদেশেও এর প্রকোপ কম নয়। মশাবাহিত সংক্রামক রোগ ম্যালেরিয়া। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে এটি হয়ে থাকে। তীব্র জ্বরের মধ্য দিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। রোগটি খুব ভয়ংকর। যথাযথ চিকিৎসা না হলে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
ম্যালেরিয়া যেভাবে ছড়ায়
‘প্লাজমোডিয়াম’ গোত্রের একধরনের এককোষী পরজীবীর কারণে রোগটি হয়ে থাকে। এই পরজীবী সাধারণত মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। মশা থেকে মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের চক্রটি এমন—
অসংক্রমিত মশা: একটি অসংক্রমিত মশা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে মশাটি নিজে সংক্রমিত হয়।
পরজীবী সংক্রমণ: এ পর্যায়ে সংক্রমিত মশাটি ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে। এটি কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে ম্যালেরিয়ার পরজীবী সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে।
যকৃতে আক্রমণ: একবার কোনো ব্যক্তির দেহে প্রবেশের পর এই জীবাণু যকৃতে (লিভার) ঘুরে বেড়ায়। ম্যালেরিয়ার এমন কিছু জীবাণু আছে যেগুলো এক বছরেরও বেশি সময় যকৃতে সুপ্তভাবে অবস্থান করে।
পরবর্তী মানুষের দেহে: চক্রের এই পর্যায়ে অসংক্রমিত মশা সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে নিজে সংক্রমিত হয়। এরপর অন্যকে কামড়ালে সেও আক্রান্ত হয়।
এছাড়া আরো যেসব উপায়ে ম্যালেরিয়া ছড়াতে পারে—
- গর্ভবতী মায়ের ম্যালেরিয়া হলেগর্ভস্থিত বা সদ্য গর্ভজাত সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নেওয়া হলে রক্তগ্রহীতা আক্রান্ত হতে পারেন।
- দূষিত বা ব্যবহৃত সুঁই ব্যবহারের মাধ্যমেও ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়িয়ে থাকে।
স্ত্রী অ্যানোফিলিস
মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া
হয়ে থাকে
ম্যালেরিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ
- তীব্র জ্বর ও কাঁপুনি
- শারীরিক অস্বস্তি ও ক্লান্তি
- মাথাব্যথা
- বমিভাব ও বমি
- পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
- পেটে ব্যথা
- ঘন ঘন নিশ্বাস
- হৃদ্গতি বেড়ে যাওয়া
- খাবারে অরুচি
যেসব জটিলতা হতে পারে
সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া : রক্তকোষে থাকা ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছোটো ছোটো রক্তনালিগুলোকে বন্ধ করে দেয়। ফলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ হতে পারে না। এ অবস্থায় মস্তিষ্ক স্ফীত হয়ে অকেজো হয়ে যেতে পারে। একে বলা হয় ‘সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া’। এ ক্ষেত্রে রোগীর খিঁচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো জটিলতা হয়। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন।
শ্বাসকষ্ট : সংক্রমণের ফলে ফুসফুসে তরল জমে যায়। এই পুঞ্জীভূত তরল পদার্থের জন্য তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
অর্গান ফেইলিউর : ম্যালেরিয়ার কারণে কিডনি, লিভার, প্লীহা, হার্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অকার্যকর (অর্গান ফেইলিউর) হয়ে যেতে পারে। এর যেকোনো একটি হলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
রক্তশূন্যতা : ম্যালেরিয়ার জীবাণুর জন্য রক্তকলায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয় এবং পর্যাপ্ত লোহিত কণিকা তৈরি হতে পারে না। ফলে রোগী রক্তশূন্যতায় (অ্যানিমিয়া) আক্রান্ত হতে পারেন।
রক্তে চিনির মাত্রা কমে যাওয়া : ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ তীব্র হয়ে গেলে রক্তে চিনির মাত্রা কমে যায়, যাকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া। এই মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন। এমনকি মৃত্যুবরণও করতে পারেন।
ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি: প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিরোধে কী করা উচিত তা সহজেই বুঝতে পারার কথা। কোনোভাবেই যেন মশা কামড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব অঞ্চলে মশার উপদ্রব বেশি সে অঞ্চলের লোকজনদের একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হবে।
সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে অ্যানোফিলিস মশার বিস্তার বেশি। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ম্যালেরিয়াপ্রবণ।
- ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- বাইরে অবস্থানকালে লম্বা জামা-কাপড়ে গা-হাত-পা ঢেকে রাখুন।
- মশা প্রতিরোধক ক্রিম, অ্যারোসল স্প্রে, মশার কয়েল, মশারি ব্যবহার করুন।
- সন্ধ্যার পূর্বে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন। প্রয়োজনে জানালায় নেট লাগিয়ে নিতে পারেন।
- বাড়ির আঙিনা পরিচ্ছন রাখুন। কোথাও যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
বিশেষ নির্দেশনা
একটা জিনিস মাথায় রাখবেন। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে এর ধরন ও সংক্রমণের তীব্রতার ওপর। যথাযথ চিকিৎসা করা না হলে রোগী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারেন। তাই দ্রুত রোগ শনাক্ত করা জরুরি। ম্যালেরিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি করা যাবে না। নিকটস্থ হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
ডা. শাহ হাবিবুর রহমান
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
ফেলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ভারত)
সহযোগী অধ্যাপক
মেডিসিন ও রিউম্যাটলজি বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
জ্বরের সময় গোসল
জ্বর সেরে গেলেও অনেকে গোসল করতে চান না। আবার জ্বরে গোসল করা উচিত না এমনও মনে করেন কেউ কেউ। এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। শরীর ঝরঝরে রাখতে গোসল দারুণ কাজ করে। অতিরিক্ত শীতবোধ না হলে গোসল করা যেতে পারে। সারা শরীরে পানি ঢেলে গোসল করতে না চাইলে মাথা ধুয়ে শরীর মুছে নিন। জ্বরে গোসল ও শরীর মোছার ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। শিশুদের গোসল না করিয়ে শরীর মুছে দেওয়া ভােলা। বড়োরা গোসলের পর মাথা ভালোভাবে মুছে চুল শুকিয়ে নেবেন। চুল ভেজা থাকলে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।