রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কী? কী করবেন?
ষাটোর্ধ্ব রাজিয়া সুলতানা বেশ কয়েকদিন ধরেই হাত ও পায়ের আঙুলের জয়েন্টে ব্যথা অনুভব করছিলেন। ধীরে ধীরে ব্যথার মাত্রা বাড়তে থাকায় এবং জয়েন্ট ফুলে যাওয়ায় তিনি হাসপাতালে যান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, তিনি যে রোগটিতে ভুগছেন তাকে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বলা হয়।
মূলত অস্থিসন্ধির প্রদাহকে বলা হয় আর্থ্রাইটিস। এটি একধরনের অটোইমিউন ডিজিজ। আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ও পরিচিত দুটি ধরন হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সূত্রপাত ঘটে হাত ও পায়ের আঙ্গুলের জয়েন্টের ব্যথার মধ্য দিয়ে, যা ধীরে ধীরে হাঁটু, পায়ের গোড়ালি ঊরুসন্ধিতে ছড়িয়ে পড়ে।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস সাধারণ মানুষের কাছে বাতরোগ হিসেবে পরিচিত। এই রোগে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। হাড়ের সংযোগস্থলের আবরণের ক্ষতি করে এবং ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের চারপাশের মাংসপেশি ফুলে যায়। এতে হাড়ক্ষয় শুরু হয় এবং হাড়ের আকৃতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। অস্থিসন্ধি ছাড়াও দেহের অন্যান্য অঙ্গ যেমন— ফুসফুস, চোখ ও রক্তনালির ক্ষতি করে এই রোগ।
যেসব কারণে হতে পারে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস
বংশগত ও অন্যান্য কারণে যেকোনো বয়সী মানুষ রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই রোগ বেশি হতে দেখা যায়। চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। আরো যেসব কারণে এর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে—
- যাদের পরিবারে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগী আছে, তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে।
- ধূমপান ও মদ্যপান রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং রোগটিকে আরো জটিল করে তোলে।
- উচ্চতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
- অস্থিসন্ধিতে আঘাত পেলে পরবর্তীকালে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হতে পারে।
- হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এটি হতে পারে।
- মহিলাদের মেনোপজের কারণে এটি হতে পারে।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে অস্থিসন্ধি ও এর আশপাশে ব্যথা হয়। আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে যায়, ফুলে যায় এবং অস্থিসন্ধির আকৃতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এছাড়া আরো যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে—
- অস্থিসন্ধি ও চারপাশের মাংসপেশিতে প্রদাহ।
- হাত-পায়ের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
- চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
- বুকে ব্যথা।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি।
- হাঁটাচলায় জড়তা।
- অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা।
- মাঝে মাঝে জ্বর হওয়া।
- হঠাৎ ওজন কমতে থাকা।
চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য রোগ না। ওষুধ, ব্যায়াম ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ রাখা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় যদি চিকিৎসা শুরু করা হয় তাহলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগ নির্ণয়ের পর দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। দেরি হলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন। যেহেতু এই রোগে আক্রান্ত হলে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব নয় তাই সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
- সাধারণত ঠান্ডায় ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই অতিরিক্ত ঠান্ডা স্থানে অবস্থান না করাই ভালো।
- পোশাকের দিকে নজর রাখা জরুরি। এমন পোশাক পরতে হবে যা শীতল পরিবেশে শরীরকে উষ্ণ রাখবে।
- শরীরে পানির ঘাটতি হলে ব্যথা বেড়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি।
- দেহের আড়ষ্টতা কমাতে নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।
- খাদ্যতালিকায় ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার রাখুন।
- বিশ্রাম কিংবা ঘুমানোর আগে গরম সেঁক দিন। এক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন। এতে অস্থিসন্ধির ব্যথা অনেকটা কমে যাবে।
শরীরের ব্যথা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভিটামিন-ডি’র ঘাটতি। এই ঘাটতি পূরণে প্রতিদিন কিছু সময় রোদে কাটান। হাড়ের ক্ষয়পূরণ, অস্টিওপোরোসিসের ক্ষেত্রেও নিয়মিত সূর্যের আলো জরুরি।
চিকিৎসকের পরামর্শমতো খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে নিন। শরীরচর্চা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. শাহ হাবিবুর রহমান
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)
ডব্লিওএইচ ও ফেলো ইন রিউম্যাটোলজি (ভারত)
মেডিসিন ও রিউমাটোলজি (বাতব্যথা/বাতজ্বর ও আর্থ্রাইটিস) বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
চেম্বার : ল্যাবএইড লিঃ (ডায়াগনস্টিকস)