রেমিটেন্ট ফিভার: জ্বরের দ্রুত ওঠানামা
শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে সেই মাত্রাকে বলা হয় জ্বর এবং জ্বরের দ্রুত ওঠানামাকে বলা হয় রেমিটেন্ট ফিভার । হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবারই আছে। কোনো কোনো জ্বর দুয়েক দিনেই সেরে যায়। আবার কোনো জ্বর মারাত্মক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, বেশ কিছুদিন ভুগতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আমাদের দেশে সাধারণত জ্বর হলে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ বা ঘরের টোটকা সেবনের প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। তবে জ্বর নিয়ে অবহেলা করা ঠিক নয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রে জ্বরকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। কন্টিনিউড, রেমিটেন্ট ও ইন্টারমিটেন্ট।
কন্টিনিউড জ্বর: রোগীর দেহের তাপমাত্রা যখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক মাত্রায় না আসে তখন সেটিকে বলা হয় কন্টিনিউড জ্বর।
রেমিটেন্ট জ্বর: ২৪ ঘণ্টায় যখন জ্বরের মাত্রা ২°সেলসিয়াস বা ৩° ফারেনহাইটের তারতম্য হয় সেটি রেমিটেন্ট জ্বর।
ইন্টারমিটেন্ট জ্বর: জ্বর যখন সারাদিনে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী আসা-যাওয়া করতে থাকে সেটি ইন্টারমিটেন্ট জ্বর।
রেমিটেন্ট ফিভার ও এর লক্ষণ
রেমিটেন্ট জ্বরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাপমাত্রার ওঠানামা অব্যাহত থাকলেও জ্বর পুরোপুরি ছেড়ে যায় না। দেহের তাপমাত্রা সহজে স্বাভাবিক হয় না। প্রায় সারা দিনই জ্বর থাকে। সাধারণত ইনফেকটিভ অ্যানডোকার্ডাইটিস (Infective Endocarditis) বা হৃদযন্ত্রের একধরনের অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে রেমিটেন্ট জ্বর দেখা দেয়। এক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে—
- তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠানামা করে।
- তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না।
- মাথা ও মাংসপেশির ব্যথা থাকতে পারে।
- কাঁপুনি ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
- মানসিক অবসাদ, ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে।
জ্বরের কারণ
- ভাইরাল ইনফেকশন
- ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন
- ফাংগাল ইনফেকশন
- খাদ্যে বিষক্রিয়া
- অতিরিক্ত তাপ
- প্রদাহজনিত সমস্যা
- টিউমার
- রক্ত জমাট বাঁধা
- বিভিন্ন ক্রনিক রোগ
রেমিটেন্ট ফিভারের মারাত্মক উপসর্গ
কখনো কখনো সাধারণ মনে হলেও জ্বরের পেছনে জটিল কোনো রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই জ্বর নিয়ে অবহেলা না করে উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া মাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। জ্বরের কিছু মারাত্মক উপসর্গ—
তীব্র মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি প্রস্রাব পুরোপুরি না হওয়া খিঁচুনি, পানিশূন্যতা ও শ্বাসকষ্ট।
রেমিটেন্ট ফিভারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যেকোনো রোগের চিকিৎসা শুরুর আগে এর কারণ নির্ণয় জরুরি। জ্বরের কারণ নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে—
- কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি (CBC)
- ইউরিয়া ও ইলেক্ট্রোলাইটস (Urea and Electrolytes)
- লিভার ফাংশন পরীক্ষা (liver Function Tests-LFTs)
- এক্স-রে ও ইসিজি
- রক্ত কালচার
- ইউরিন কালচার
চিকিৎসা ও সচেতনতা
জ্বর হলে শুরুতে প্রয়োজন বুঝে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না। এছাড়া এ সময় যেসব বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন—
- তাপমাত্রা ১০১° ফারেনহাইটের বেশি হলে কমানোর ব্যবস্থা নিন।
- তাপমাত্রা কমাতে শরীর বারবার মুছে দিতে পারেন।
- রোগীকে আলো-বাতাসপূর্ণ, উষ্ণ ও শুষ্ক স্থানে রাখুন।
- পুষ্টিকর ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে দিন।
- রোগীকে মৌসুমি ফল, পানি ও তরল খাবার খাওয়ান।
- পানিশূন্যতা দূর করতে ফলের রস, স্যালাইন, ডাবের পানি দিতে পারেন।
- বেশি ঠান্ডা পানিতে গোসল করবেন না।
- চা-কফি, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়মিত হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় নাকে-মুখে রুমাল ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন। অতিরিক্ত রোদ ও গরমে বাইরে ঘোরাফেরা এড়িয়ে চলুন। তিন দিনের মধ্যে জ্বরের মাত্রা না কমলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডা. সুমন্ত কুমার সাহা
এমবিবিএস, এমডি (কার্ডিওলজি), এমআরসিপি(ইউকে)
এমআরসিপিএস (গ্লাসগো), এমআরসিপিই(এডিন)
এমআরসিপি(লন্ডন)
মেডিসিন, হৃদরোগ ও বার্ধক্যজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল