শিশু ওবেসিটির শিকার হয়নি তো?

ডা. আজমেরী সুলতানা চৌধুরী

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাতুলের বয়স ১১ বছর। তার মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন। কারণ, দিন দিন সে মোটা হয়ে যাচ্ছে। মেপে দেখা গেল, তার ওজন ৭৫ কেজি। যদিও কিছুটা বাড়বাড়ন্ত শরীর রাতুলের। কিন্তু করোনা মহামারির আগে অবস্থা এতটা দুশ্চিন্তার ছিল না। লকডাউনে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার ফলে অস্বাভাবিক হারে ওজন বেড়ে গেছে।

এই যে বয়সের তুলনায় ওজন বেশি- এটাকেই বলে স্থূলতা বা ওবেসিটি। কেবল রাতুল নয়, বহু শিশুই এর শিকার হয়েছে এখন। এই করোনা-লকডাউন সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি করেছে মূলত শিশুদেরই।

লকডাউনে বেড়েছে শিশুর মেদ

স্কুল বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস। মোবাইল বা কম্পিউটারে বসে বসে সময় কাটছে। বাইরে যাওয়া নেই। বন্ধ বাইরের খেলাধুলা। নেই হৈহুল্লোড়। নিয়ম করে শরীরচর্চাও হয় না। প্রবল বিরক্তি আর আলস্যের জীবনযাপন। শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন পার হয়ে যাচ্ছে। চকোলেট, বার্গার, পিৎজা; শিশুমন যখন যা খেতে চাইছে, খাচ্ছে। বাবা-মাও মানা করছেন না। এটা-ওটা খেয়ে যদি একটু মন ভালো থাকে, খাক না! কিন্তু মন ভালো থাকেনি শিশুর। বন্দিজীবন, অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, হুট করে পরীক্ষা; এমন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যেই সময় কেটেছে তাদের। দুশ্চিন্তা মেটাবলজিম তথা হজমপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়। খিদেও পায় বেশি। কিন্তু সে অনুযায়ী খাবার বার্ন হয় না। লকডাউনে যথাযথ পরিমাণে ক্যালরি খরচ হয়নি। ফলে বেড়ে গেছে মেদ। আপাতত শেষ হয়েছে লকডাউন। তবে এই ঘরবন্দি লকডাউন কেড়ে নিয়েছে শিশুর শৈশব। বিপরীতে দিয়ে গেছে ‘ওবেসিটি’র মতো বিব্রতকর এক অসুখ।

ওবেসিটি

ওবেসিটির অর্থ স্থূলতা। তবে এটি দিয়ে কেবল ওজনবৃদ্ধিই বোঝায় না। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) অনুযায়ী দেহের উচ্চতার বিবেচনায় ওজন বেড়ে গেলে তখনই তা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

যেসব কারণে ওজন বাড়ে

সাম্প্রতিক একটি কারণ অবশ্যই লকডাউন এবং এটি বেশ বড়ো প্রভাবকই বটে। কিন্তু এর বাইরে শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কতগুলো বিষয়। যেমন-

  • বংশানুক্রমিক ধারা
  • হরমোন
  • পরিবেশ
  • জীবনযাপন
  • খাদ্যাভ্যাস

শিশুদের ওবেসিটির ক্ষেত্রে সাধারণত নিম্নোক্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়-

  • রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়।
  • উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের সমস্যা ও ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দেয়।
  • হাড় ও গিঁটে ব্যথা হয়।
  • ঘুমের মধ্যে নাকডাকা ও শ্বাসকষ্ট হয়।
  • পিত্তথলিতে পাথর বা প্রদাহ হয়।
  • শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দেখা দেয়।
  • ঘাড় ও ত্বকের ভাঁজে ভাঁজে কালো দাগ দেখা দেয়।
  • অল্প বয়সেই ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ ওঠা বা মেয়েশিশুদের মাসিক হওয়ার মতো বিব্রতকর সমস্যা হয়।
  • চর্বি জমে গিয়ে লিভারের স্থায়ী সমস্যা হতে পারে।

স্থুলতা রোধে মা-বাবার করণীয়

  • শিশুর ওজন বৃদ্ধি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে একটি চার্ট রাখতে হবে।
  • কৌটার দুধ বা কৃত্রিম খাবার খাওয়ালে শিশু দ্রুত মোটা হয়ে যায়। তাই শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ান। এটি ওজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিরোধকের মতো কাজ করে।
  • ছয় মাস বয়স থেকে অন্যান্য খাবার দিতে হবে, যাতে অবশ্যই শাকসবজি, ফলমূল থাকবে। ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম প্রভৃতি বাইরের খাবার যতটা সম্ভব কম দিতে হবে।
  • শিশুকে নড়াচড়া ও চলাফেরার মধ্যে রাখতে হবে। নিজের কাজ নিজে করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং বাইরে খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে।
  • লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ির ব্যবহার, প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম ও বাড়ির কাজে শিশুর অংশগ্রহণ ইত্যাদি শিশুকে ফিট রাখতে সহায়তা করবে। এসব অভ্যাস করানোর পাশাপাশি স্কুলে বা হাঁটা দূরত্বে গাড়ি বা রিকশা ব্যবহার না করে শিশুকে হেঁটে যাতায়াতের অভ্যাস করান।
  • শিশু মুটিয়ে যাচ্ছে, এমনটি সন্দেহ হলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি উচ্চতা ও ওজন মেপে এবং প্রয়োজনে নানা পরীক্ষা করে ঠিক করবেন আপনার শিশু আসলেই ওবেসিটির দিকে যাচ্ছে কি না।

ডা. আজমেরী সুলতানা চৌধুরী

ডা. আজমেরী সুলতানা চৌধুরী
এমবিবিএস, এফসিপিএস (শিশু রোগ)
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট
ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিক্স অ্যান্ড নিউনেটোলজি
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp