শীতকালে ফুসফুসের যত্ন

অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন

শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ, রক্ত হতে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেঁকে বাইরে বের করে দেওয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে ফুসফুস। নানা কারণেই অঙ্গটি আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে ফুসফুসের রোগের অন্যতম কারণ পরিবেশদূষণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। শীতকালে আবহাওয়ার তারতম্য এবং বায়ুমণ্ডলে ধুলোবালির উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় এ সময় ফুসফুসে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এখন আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। যার প্রধান লক্ষ্যস্থল ফুসফুস। এমন পরিস্থিতিতে ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে মেনে চলতে হবে সঠিক নিয়মকানুন।

শীতে ফুসফুস সুস্থ রাখতে করণীয়

তামাকবিহীন স্বাস্থ্যকর জীবন

মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর প্রায় চার হাজার রাসায়নিক পদার্থ আছে তামাকে। ধূমপানের মাধ্যমে নিকোটিন, কার্বন মনোক্সাইডের মতো অসংখ্য রাসায়নিক ফুসফুসে প্রবেশ করে এর কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। ধূমপান ত্যাগ করার বিশ মিনিটের মধ্যে হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হয়ে আসবে, ১২ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে। ২-১২ সপ্তাহের মধ্যে ফুসফুসের রক্তসঞ্চালন ও কর্মক্ষমতার উন্নতি হবে। ১-৯ মাসের মধ্যে কাশি ও শ্বাসকষ্ট কমে যাবে এবং দশ বছরের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের আশঙ্কা অর্ধেকে নেমে আসবে।

শরীরচর্চা, কায়িক পরিশ্রম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম

পরিশ্রমবিহীন অলস জীবনযাপন ফুসফুসের কর্মক্ষমতাকে দুর্বল করে। শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধিতে শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীরচর্চা জরুরি। দৌড়ানো, সাঁতার, দড়িলাফ, সিঁড়ি ভাঙা, দ্রুত হাঁটা, সাইক্লিং, ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল প্রভৃতি খেলাধুলা ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও সচল রাখতে সহায়তা করে। আবার অতিরিক্ত পরিশ্রম স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। ফুসফুসের যত্নে পর্যাপ্ত শারীরিক বিশ্রাম ও ঘুম অপরিহার্য।

শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম

ফুসফুসের কার্যকর একটি ব্যায়াম হচ্ছে, অ্যাক্টিভ সাইকেল অব ব্রিদিং টেকনিক। কৌশলটি খুবই উপকারী। এই ব্যায়ামের রয়েছে ৩টি ধাপ।

শ্বাস নিয়ন্ত্রণ

শ্বাস নিয়ন্ত্রণ: কাঁধ ও পেট শিথিল করে আরামের সাথে ৩-৪ বার নিঃশ্বাস নিন ও ছাড়ুন।

লম্বা শ্বাস: লম্বা শ্বাস নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন। তারপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। এভাবে ৩-৪ বার করুন।

হাফিং: বুকভরে শ্বাস নিন। পেটের পেশি সংকুচিত করে মুখ দিয়ে ১-২ বার কাশি দিয়ে কফ বের করুন।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

শুধু শীতকালে ফুসফুস সক্রিয় রাখতেই নয়, সারা-বছর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ধরে রাখা উচিত। সুস্বাদু কিন্তু পুষ্টিহীন, শরীরের জন্য ক্ষতিকর এমন খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ফুসফুসের সুরক্ষায় মৌসুমি শাক-সবজি, ফলমূল ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে।

পর্যাপ্ত পানি পান

বিশুদ্ধ পানি ফুসফুসে ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৬-৮ গ্লাস পানি পান করা জরুরি।

বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা

শীতকালেও নিয়মিত গোসল করতে হবে। পরিষ্কার রাখতে হবে বাড়ি-ঘর ও কর্মস্থল। সকালের দিকে ঘরের জানালা দরজা খোলা রাখা দরকার, যাতে পর্যাপ্ত আলো ও বিশুদ্ধ বাতাস চলাচল করতে পারে।

ঘরে রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার না করা

অনেক সময় ঘরে মশা তাড়ানো কিংবা দুর্গন্ধ দূর করতে আমরা রাসায়নিক উপাদানসমৃদ্ধ স্প্রে ব্যবহার করি, যা ফুসফুসের জন্য মোটেও ভালো নয়।

চাই নির্মল বাতাস

ফুসফুস সুরক্ষায় অন্যতম নিয়ামক বিশুদ্ধ বাতাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই দূষিত বাতাস সেবন করে, যা ফুসফুসের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা ও নির্মল বায়ুসেবনের মাধ্যমে ফুসফুসের যত্ন নিন।

ফুসফুসের নিরাপত্তায় টিকা

প্রতিবছর শীতের আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরালজনিত ফুসফুসের যে সংক্রমণ নিউমোনিয়ায় রূপান্তরিত হতে পারে, তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিষেধক টিকা নেওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া, যার প্রধান কারণ ‘স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি’; তা প্রতিরোধ করার জন্য নিউমো ভ্যাক্স-২৩ অথবা কনজুগেট ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা উচিত।


অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন

এমবিবিএস, এফসিসিপি, এফআরসিপি, পিএইচডি, এফসিপিএস
ফেলো পালমনোলজি স্লিপ মেডিকেল আইসিইউ (সিঙ্গাপুর)
মেডিসিন, বক্ষব্যাধি ও স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
প্রফেসর, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (অ্যাকাডেমিক)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল


Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp