ডা. মো. জাকির হোসেন সরকার
নিউমোনিয়ার সঙ্গে শীতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শীতকাল এলেই রোগটি বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠে। এদিকে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একক কারণ এই রোগ। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই নিউমোনিয়ার প্রকোপ থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। আবার এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের। ফলে সচেতন না হলে নিউমোনিয়া, শীত এবং কোভিড-১৯ এর ত্রিমুখী আক্রমণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
কেন হয় নিউমোনিয়া
‘নিউমো’ শব্দের অর্থ ফুসফুস-সংক্রান্ত। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগ এই নিউমোনিয়া। আমাদের ফুসফুসে বাতাস-ভর্তি অনেক পাউচ বা অ্যালভিয়োলাই রয়েছে। এই অ্যালভিয়োলাই কোনো কারণে সংক্রমিত হলে তাতে পুঁজ বা ফ্লুয়িড জমা হয়। তখন তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, টিবি প্রভৃতির জীবাণুর আক্রমণে নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। ‘স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি’ নামের ব্যাকটেরিয়াও এক্ষেত্রে দায়ী।
নিউমোনিয়ার উপসর্গসমূহ
নিউমোনিয়ার লক্ষণ বা উপসর্গ বিভিন্ন রকম হতে পারে। এটি নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং কোন ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে তার ওপর। আক্রান্ত হলে সাধারণত নিম্নোক্ত উপসর্গসমূহ প্রকাশ পেয়ে থাকে।

- কাশি হয় এবং কাশির সঙ্গে সবুজাভ বা হলুদাভ কফ বের হয়।
- কফের সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
- জ্বর হয় এবং তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফরেনহাইটের অধিক হয়।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বুকে ব্যথা করে।
- শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের নিচের অংশ ভিতরের দিকে দেবে যেতে পারে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্ত লক্ষণ ছাড়াও ক্ষুধামান্দ্য, অস্থিরতা, খিঁচুনি ও পেটে ব্যথা হতে পারে।
শীতে কেন বাড়ে নিউমোনিয়ার প্রকোপ
• শীতকালে সাধারণত মানুষ ঘরে তথা বদ্ধ পরিবেশে তুলনামূলক বেশি সময় কাটায়। ফলে বদ্ধ আবহাওয়ায় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণের সুযোগ থাকে বেশি।
• শীতের অনুকূল আবহাওয়ার ফলে বাতাসে রেসপিরেটরি ড্রপলেট (হাঁচি-কাশির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির নাক ও মুখ দিয়ে নিঃসৃত জলীয় কণা) অনেকক্ষণ ধরে স্থায়ী হয়।
• এ সময় মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়।
নিউমোনিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের।
যাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি
- ৫ বছরের কম বয়সী শিশু ও ৬৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি।
- নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু।
- কম ওজন-সম্পন্ন শিশু।
- সময়মতো টিকা দেওয়া হয়নি এমন শিশু।
- দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন- ডায়বেটিস, হৃদরোগ এইডস, ব্রংকাইটিস ইত্যাদিতে ভুগছেন এমন ব্যক্তি।
- ধূমপায়ী ও মাদকাসক্ত ব্যক্তি।
- ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন কিংবা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করছেন এমন ব্যক্তি।
- ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত ব্যক্তি।
- যারা কোভিড-১৯ নিউমোনিয়া রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত।
রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
- ফুসফুসের এন্ডোস্কোপি
- এক্স-রে, সিটি স্ক্যান
- রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা
- রক্ত পরীক্ষা, কফ, শ্লেষ্মা পরীক্ষা
প্রতিরোধে করণীয়
শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার সংক্রমণঝুঁকি বেশি। ফলে শীতের সময় তাদের বাড়তি যত্নের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখুন-

- শিশুকে সময়মতো সবগুলো টিকা দেওয়া হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করুন।
- শিশুদেরকে সিগারেটের বা চুলার ধোঁয়া ও ধুলোবালি থেকে দূরে রাখুন।
- শিশু এবং বয়স্কদের ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখুন।
- পুষ্টিকর খাদ্য ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করুন।
- যারা এখনো কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহণ করেননি তারা অতিদ্রুত টিকা গ্রহণ করুন।
- নিয়মিত ফ্লু ও নিউমোনিয়ার টিকা গ্রহণ করুন
- হাঁচি বা কাশি দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই হাত বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে নিন।
- ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বর্জন করুন।
- বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
- নিয়মিত শরীরচর্চা করুন।

ডা. মো. জাকির হোসেন সরকার
এমবিবিএস, ডিটিসিডি, এমডি (চেস্ট)
বক্ষব্যাধি, স্লিপ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক (রেসপিরেটরি মেডিসিন)
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
সিনিয়র কনসালট্যান্ট (বক্ষব্যাধি ও স্লিপ মেডিসিন)
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা।
