সড়ক দুর্ঘটনাজনিতহাড় ভাঙার ধরন ও করণীয়
সন্ধ্যাবেলা মোটরসাইকেলে চেপে অফিস থেকে ফিরছিলেন আসিফ আহমেদ। পেছন থেকে একটি যাত্রীবাহী বাস এসে সজোরে ধাক্কা দিলে তিনি ছিটকে পড়ে যান। কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলেন, তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। ডান পা একেবারে অবশ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পথচারীরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেন। এক্সরে করে দেখা গেল, ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে।

আসিফ আহমেদের মতো এমন অবস্থায় যে কেউ পড়তে পারেন। প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে গিয়ে যেকোনো সময় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরীরের হাড়। হাড় ভেঙে যাওয়া, একাধিক টুকরো হয়ে যাওয়া বা চিড় ধরার মতো জটিল সমস্যা হয়। এমতাবস্থায় কোনোভাবেই সময় নষ্ট করা যাবে না। দ্রুত দুর্ঘটনায় আহত রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার ফলে হাড় ভাঙার ধরন
সাধারণত সড়ক দুর্ঘটনার ফলে হাড় ভাঙার নিম্নোক্ত ধরনগুলো দেখা যায়—
অ্যাভালশন ফ্র্যাকচার : হাড় ভাঙার সবচেয়ে জটিল ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা এটি। এতে ভাঙা হাড় টেন্ডন ও লিগামেন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়।
ওপেন ফ্র্যাকচার : একে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচারও বলা হয়। এতে হাড় ভেঙে মাংস ও চামড়া ভেদ করে বাইরে চলে আসে। তখন হাড়ের সঙ্গে কাদা-মাটি, ধুলোবালি মিশে যায়। অনেকসময় এসব ময়লা ভেতরে ঢুকে যায়। ফলে পরবর্তীকালে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রোপচার করতে হয়। সেই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এড়াতে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ও টিটেনাস টিকার মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
ট্রান্সভার্স ফ্র্যাকচার : এক্ষেত্রে হাড় ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায়। এই অস্থিভঙ্গ সমকোণ আকারে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্প্লিন্ট বা কাস্টের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়াহীন রাখতে হয় এবং পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। কখনো কখনো অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে।
কমুনিউটেড ফ্র্যাকচার : এক্ষেত্রে হাড় ভেঙে তিন বা তার অধিক টুকরো হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়ই এই ভাঙন আর জোড়া লাগে না। অনেক সময় অঙ্গচ্ছেদের দরকার হতে পারে।
অব্লিক ফ্র্যাকচার : অব্লিক ফ্র্যাকচারে হাড় তীর্যকভাবে ভেঙে যায়। এক্ষেত্রে হাড় প্রতিস্থাপনের জন্য অস্ত্রোপচার দরকার হয় এবং স্ক্রু দিয়ে হাড় যথাস্থানে জোড়া দিয়ে দেওয়া হয়।
গ্রিন স্টিক ফ্র্যাকচার : গাছের সবুজ নরম ডাল ভাঙার সময় যেমন পুরোপুরি না ভেঙে উক্ত স্থানে বাঁকা হয়ে চিড় ধরে এক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটে। এই ফ্র্যাকচারে হাড় পুরোপুরি ভাঙে না। কিন্তু সেই জায়গা বাঁকা হয়ে যায় এবং চিড় ধরে। কাস্ট বা স্প্লিন্টের মাধ্যমেই এই ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে। সাধারণত গ্রিন স্টিক ফ্র্যাকচার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি করতে হয়।
হেয়ারলাইন ফ্র্যাকচার : এক্ষেত্রে হাড় ভাঙে খুব ক্ষুদ্রভাবে। অধিকাংশ সময় রোগী বুঝতেই পারেন না যে তার হাড় ভেঙেছে। ফলে এ ধরনের সমস্যায় ঝুঁকিও বেশি। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না গেলে ধীরে ধীরে হাড় ভাঙার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সাধারণত কাস্ট, স্প্লিন্ট বা বুটের আবরণের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়।
জটিলতা নির্ণয়
সড়ক দুর্ঘটনাজনিত হাড় ভাঙা নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন, প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক ক্ষতস্থানের উপসর্গ দেখে তাদের হাড় ভাঙার ধরন বোঝার চেষ্টা করেন। অধিকতর নিশ্চয়তার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়। চিকিৎসক যেসব উপসর্গের দিকে লক্ষ করেন—
- ভাঙা হাড় বাইরে বেরিয়ে এসেছে কি না
- আক্রান্ত স্থান ফুলে গেছে কি না বা থেঁতলে গেছে কি না
- আক্রান্ত অঙ্গ বিকৃত হয়ে গেছে কি না
- ব্যথার তীব্রতার মাত্রা কেমন
কী করবেন
সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে এবং আহত হলে কিছু ব্যাপার মাথায় রাখা জরুরি। যেমন—

- কোনোভাবেই কালক্ষেপণ করা যাবে না। নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাবেন। চিকিৎসা শুরু করতে যেন দেরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
- আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার কাপড় দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে, যাতে রক্তক্ষরণ না হতে পারে।
- আহত ব্যক্তি মেরুদণ্ডে আঘাত পেলে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করত হবে। অন্তত তিনজন মিলে রোগীকে এমনভাবে ধরুন যাতে রোগীর শরীর মোচড় না খায়। রোগীকে কোনোক্রমেই বসানো যাবে না। সোজা করে শুইয়ে হাসপাতালে নিতে হবে।

ডা. কাজী শহীদ-উল আলম
এমবিবিএস (ডিএমসি), বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমএস (অর্থো), ডিএমসি
ফেলো পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জারি, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া
সহকারী অধ্যাপক, পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল