সর্বাঙ্গে ব্যথা: ফাইব্রোমায়ালজিয়া
-অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ

-কী সমস্যা বলুন তো।
রোগী একটু নড়েচড়ে বসলেন। চোখেমুখে শারীরিক ব্যথার ছাপ স্পষ্ট। বাম হাত দিয়ে ডান কাঁধের পেশি শক্ত করে টিপে ধরে আছেন।
-স্যার, সমস্যার কথা কী আর বলব! শরীরজুড়ে প্রচণ্ড ব্যথা।
-ওই যে বললাম, সর্বাঙ্গে ব্যথা!
ভদ্রলোকের নাম চঞ্চল মাহমুদ। বয়স ৫২ বছর। কথা বলে যতটুকু জানা গেল, নাম চঞ্চল হলেও চঞ্চল-মুখর জীবন কাটাতে পারেননি। ব্যাংকে চাকরি করার ফলে কর্মঘণ্টার প্রায় পুরো সময়টাই চেয়ারে বসে কাটাতে হয়। তাছাড়া তিনি নিজেও বেশ আরামপ্রিয় ও অলসপ্রকৃতির। রক্তপরীক্ষা, এক্স-রেসহ আরও দুয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলাম। দুই দিন পর রিপোর্ট নিয়ে এলেন। রিপোর্টে চোখ বুলাতেই বুঝলাম, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। ওনার ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়েছে।
রোগের নাম শুনেই চঞ্চল সাহেব ভড়কে গেলেন। বললেন—
-আগে তো এ নাম শুনিনি! কী এই ফাইব্রোমায়ালজিয়া?
-ওই যে বললেন, সর্বাঙ্গে ব্যথা। ঠিক তাই।
ফাইব্রোমায়ালজিয়া
হ্যাঁ, সর্বাঙ্গে ব্যথার যে রোগ, এর নামই ফাইব্রোমায়ালজিয়া। এর ফলে পুরো শরীরের সব পেশি ও নরম টিস্যুগুলোতে ব্যথা হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্যথা সংবেদনশীলতা অন্যদের চেয়ে বেশি। এছাড়া তাদের শরীরে এমন অনেক জায়গা থাকে, যেখানে হালকা স্পর্শ করলেও তীব্র ব্যথা হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
রোগটি এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা। প্রচুর মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তবে সচেতনতার অভাবে চিকিৎসা নিতে দেরি করেন। এ রোগে নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা যায়।
• সারা শরীরে বিরামহীন ব্যথা হওয়া।
• অস্থিসন্ধি, যেমন কাঁধের ওপরের দিকে, হাঁটু, কনুই, কোমরে ব্যথা হওয়া।
• মাথার পেছনের দিকে ব্যথা হওয়া।
• মাংসপেশি ও টেন্ডনগুলোতে (মাংসপেশির প্রান্তভাগ) ব্যথা হওয়া।
• মাংসপেশিতে জমাটবদ্ধতা এবং খিঁচুনি অনুভব করা।
• ক্লান্ত ও অবসন্ন লাগা।
• কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা, চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়া বা কোনোব্যাপারে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
• অনিদ্রায় ভোগা।
• ত্বকে ফুসকুড়ি ও চুলকানি হতে পারে।
• ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধামান্দ্য- প্রভৃতি হজমজনিত সমস্যায় ভোগা।
• অনেকসময় কথাবার্তাও জড়িয়ে যেতে পারে।

ফাইব্রোমায়ালজিয়ার কারণ
ঠিক কী কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে অলস জীবনযাপন, শারীরিক পরিশ্রম না করা, কোনো আঘাত, অন্য কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া—প্রভৃতি কারণে এটি হতে পারে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে—
বংশগতির প্রভাব: কিছু জিনের মিউটেশনের কারণে এই রোগটি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। পরিবার বা রক্তসম্পর্কীয় কারো এ রোগ থাকলে, অন্যান্য সদস্যেরও এটি হতে পারে।
ট্রমা: তীব্র কোনো মানসিক আঘাতের কারণে ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়ে থাকে।
উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা: অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ শরীর থেকে হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ ঘটায়। মনের পাশাপাশি শরীরও নানাবিধ জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। দুশ্চিন্তা হতে পারে ফাইব্রোমায়ালজিয়ার কারণ।
সংক্রমণ: ফ্লু, নিউমোনিয়া প্রভৃতি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকেও ধীরে ধীরে দীর্ঘকালীন ফাইব্রোমায়ালজিয়া হতে পারে।
বিষণ্ণতা: অতিরিক্ত হতাশা বা বিষণ্ণতা ফাইব্রোমায়ালজিয়া তৈরি করতে পারে। ফাইব্রোমায়ালজিয়াকে বাই-পোলার ডিজ-অর্ডারের পার্শ্বরোগ হিসেবে দেখা হয়।
ফাইব্রোমায়ালজিয়া প্রতিকারে করণীয়
এই রোগ এড়ানোর জন্য ছন্দোবদ্ধ জীবনযাপন জরুরি। আলস্য পরিহার করতে হবে। পেশাগত কারণে অনেকক্ষণ বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকার দরকার হলে, কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে হবে। এছাড়া নিম্নোক্ত নির্দেশনা মেনে চললে সর্বাঙ্গে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
- গড়ে তুলুন নিয়ন্ত্রিত, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ খাবেন। এক্ষেত্রে মাংসের চেয়ে মাছ, বিশেষত সামুদ্রিক মাছ খাওয়া ভালো।
- শাক-সবজি, ফলমূল খেতে হবে নিয়মিত। পালংশাক, লেটুস পাতা, পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, শসা, আপেল কমলালেবু প্রভৃতি খাবার নিয়মিত খাবেন।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবেন।
- লবণ যত কম খাওয়া যায় তত ভালো।
- ঘন ঘন ও পর্যাপ্ত পানি করতে হবে।
- নিয়মিত শরীরচর্চা ও কায়িক পরিশ্রম করবেন।

অধ্যাপক ডা.সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ
এমবিবিএস, এফিসিপিএস, পিএইচিড, এমএসিপি (আমেরিকা)
অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুিজব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা
পেইন মেডিসিন ও রিউম্যােটালিজ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার: ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিক)