সিফিলিসে অবহেলা নয়
-ডা. মোঃ আজিজুল হক
যৌনবাহিত রোগ সিফিলিস মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে—গত দুই দশক ধরে এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু এখন এই চিত্র বদলে গেছে। সম্প্রতি এর প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭১ লক্ষ মানুষ সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের বয়স ১৫—৪৯ বছর। ব্যাপারটা উদ্বেগের। আরো চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর খুব একটা সচেতনতা নেই। বিশেষত বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তো যেকোনো যৌনবাহিত রোগ নিয়ে কথা বলাই একধরনের ট্যাবু। অথচ রোগটি নিরাময়যোগ্য। কিন্তু তার জন্য চাই যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা। তা না হলে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। প্রভাব পড়তে পারে পরবর্তী প্রজন্মেও।

সিফিলিস কী
পৃথিবীর প্রাচীনতম ও প্রধানতম যৌনরোগ সিফিলিস। ট্রেপনোমা প্যালিডাম নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এটি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত যৌন মিলনের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। সিফিলিস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলন, মুখ মৈথুন বা চুম্বনের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে রক্ত গ্রহণ করলে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে। গর্ভবতী মা সিফিলিসে আক্রান্ত থাকলে গর্ভস্থিত সন্তানও এতে আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
সংক্রমণের পর এই ব্যাকটেরিয়া কোনোরূপ উপসর্গ ছাড়াই বহুদিন শরীরে অবস্থান করতে পারে। যখন সক্রিয় হতে শুরু করে তখন সাধারণত চারটি ধাপে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
প্রথম ধাপ : প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির যৌনাঙ্গে, মুখে বা পায়ুপথে একধরনের কালশিটে বা ক্ষত দেখা দেয়। কারো ক্ষেত্রে ঠোঁট, জিহ্বা বা আঙুলেও দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ সময় একটিমাত্র গুঁটি বা ফুসকুড়ি দেখা যায়।
তবে একাধিকও হতে পারে। এই ক্ষত ব্যথাহীন। দেখতে অনেকটা পোকার কামড়ের মতো গোল। সংক্রমণের তিন সপ্তাহের মাথায় এই লক্ষণ প্রকাশ পায়।

দ্বিতীয় ধাপ : সংক্রমণের তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে উপর্যুক্ত গুঁটি নিরাময় হয়ে শরীরে র্যাশ উঠতে শুরু করে। তবে ব্যথা বা চুলকানি হয় না। লাল বা লালচে-বাদামি রং ধারণ করে। এই র্যাশ বা ফুসকুড়ি বুকে, পেটে, পিঠে ছড়িয়ে যায়। হাতের তালু ও পায়ের তলাতেও এমন হতে পারে। এ পর্যায়ে মুখে বা যৌনাঙ্গে আঁচিলের মতো ঘা দেখা দেয়। জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেশিব্যথা, ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে থাকে।
সুপ্ত ধাপ : এ পর্যায়ে রোগীর শরীরে কোনো উপসর্গ দৃশ্যমান থাকে না। ফলে একে সুপ্ত বা গুপ্ত পর্যায় বলা হয়। কখনো কখনো সিফিলিস আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়। উপসর্গ চলে যাওয়ার পর আর ফিরে নাও আসতে পারে। কিন্তু ভালো না হলে এবং চিকিৎসা করা না হলে নতুনভাবে লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এই সুপ্ত পর্যায় অনেকদিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এমনকি ২০ বছর পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখা দিতে নাও পারে।
তৃতীয় ধাপ : একে বিলম্বিত পর্যায়ও বলা যায়। উপরোল্লিখিত তিনটি পর্যায়ে চিকিৎসা না করা হলে এ পর্যায়ে এসে রোগী জটিল অবস্থায় পড়ে যেতে পারেন। মস্তিষ্কবিকৃতি, স্মৃতিভ্রমসহ নানা শারীরিক অসুবিধা তৈরি হতে থাকে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত হয় মূলত বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। স্নায়ু, রক্তনালি, লিভার অকার্যকর হওয়ার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়। হৃদযন্ত্রঘটিত নানা রোগ হয়। কমে যায় দৃষ্টিশক্তি। রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারেন।
প্রতিরোধে করণীয়
এই রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। শরীরে উপর্যুক্ত লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে। বিয়ের আগে নারী-পুরুষ উভয়ের সিফিলিস পরীক্ষা করানো উচিত। প্রতিটি গর্ভবতী নারীরও এই পরীক্ষা করা দরকার। যৌনমিলনে কনডম ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন নিশ্চিত করতে হবে।

ডা. মোঃ আজিজুল হক
এমবিবিএস (ঢাকা), ডি, ডি (থাইল্যান্ড-জাপান)
চর্ম, যৌন (সেক্স) ও অ্যালার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ
কনসালট্যান্ট, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগ
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
চেম্বার : ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিক)
ধানমন্ডি, ঢাকা