স্পন্ডিলাইটিস হলে কী করবেন
সাজ্জাদ সাহেবকে তাঁর বস আজ একটু আগেই অফিসে যেতে বলেছিলেন। ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়তে গিয়ে বুঝলেন, আজ শরীরের জড়তাটা একটু বেশি। সেই সঙ্গে কোমরের ব্যথাটাও। বেশ কয়েক মাস ধরেই এ ব্যথা হচ্ছিল। কম্পিউটারে সারাক্ষণ কাজ করতে হয় বলে এই ব্যথা—এমনটাই মনে করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে যেতেই বুঝলেন, তাঁর চোখ দুটো একটু লাল। তিনি একটু ঘাবড়ে গেলেন। সেদিনই অফিস শেষ করে চিকিৎসকের কাছে গেলেন। লক্ষণ শুনে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানালেন, অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন সাজ্জাদ হোসেন।
রোগটি খুব যন্ত্রণাদায়ক। যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। আর এতে যে কী পরিমাণ অসহনীয় ব্যথা হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন।
অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস কী
অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস মেরুদণ্ডের সন্ধি ও লিগামেন্টের প্রদাহজনিত ব্যথা। সাধারণত মেরুদণ্ডের জয়েন্ট ও লিগামেন্টগুলো আমাদের নড়াচড়া, ওঠাবসার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। কিন্তু স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে এই অস্থিসন্ধি ও লিগামেন্টগুলো শক্ত হয়ে যায়। কখনো কখনো এই প্রদাহ কশেরুকায় ছড়িয়ে যায়, যা মেরুদণ্ডে জড়তা তৈরি করে। ফলে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয় এবং ঘাড় ও কাঁধসহ পুরো পিঠজুড়ে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
যারা আক্রান্ত হতে পারেন
আগেই বলা হয়েছে, যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। যেমন—
পারিবারিক ও বংশগত : পরিবারের কারো স্পন্ডিলাইটিস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের যেকোনো সদস্য এতে আক্রান্ত হতে পারেন।
এইচএলএ-বি ২৭ : যাদের দেহে এইচএলএ-বি ২৭ নামের জিনের উপস্থিতি আছে, তাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
বয়স : সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের আগেই স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশু ও কিশোর বয়সেও এতে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
লিঙ্গভেদ : মহিলাদের চেয়ে কমবয়সী পুরুষদের এতে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস হওয়ার কারণ
স্পন্ডিলাইটিস কেন হয়, যথাযথভাবে এর কারণ জানা যায় না। বংশগত কারণে এর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তবে বংশের কারো এ রোগ থাকলে অন্য কেউ এতে আক্রান্ত হবেনই এমন কোনো কথা নেই। পরিবেশগত কিছু কারণও এর জন্য দায়ী। কোনো কোনো সময় সংক্রমণের পরবর্তীকালে এটি হতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যাটি গুরুতর নাও হতে পারে। হালকা ব্যাকপেইনের পাশাপাশি অল্প সময়ের জন্য মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় ব্যথা হয়, আবার দ্রুত সেরেও যায়। কিন্তু কেউ কেউ জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে—
- ব্যথা নিতম্ব, পাঁজর, কাঁধ, হাঁটু, গোড়ালি ও পায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।
- ব্যথার সঙ্গে আক্রান্ত স্থান অবশ হয়ে যেতে পারে এবং সুচ ফোটার মতো বোধ হতে পারে।
- মাথাব্যথা, মাথাঘোরা কিংবা মাথা ঝিম ধরে থাকার মতো সমস্যা হয়।
- হতে পারে শ্বাসকষ্ট। সাধারণত পাঁজর আক্রান্ত হলে শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা হয়।
- চোখে ব্যথা হতে পারে। এমনকি দৃষ্টিশক্তিতেও প্রভাব পড়তে পারে।
- সবসময় অবসন্ন লাগে এবং ক্লান্তিবোধ হয়।
- খাবারে অরুচি তৈরি হতে পারে এবং দ্রুত ওজন হ্রাস পেতে পারে।
- কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বকে র্যাশ উঠতে দেখা যায়।
- তলপেটে ব্যথা হতে পারে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
কী করবেন
স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের দ্বারস্ত হোন। যথাযথ চিকিৎসার পাশাপাশি নিম্নোক্ত নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
নিয়মমাফিক জীবনযাপন : নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন নিশ্চিত করুন। পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম জরুরি।
শরীরচর্চা : নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ : পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস হাড়কে শক্ত করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবার, যেমন সামুদ্রিক মাছ, বাদাম প্রভৃতি খাবেন। শাকসবজি, ফলমূল খেতে হবে নিয়মিত।
শোয়া-বসার ভঙ্গি : বালিশ ছাড়া ঘুমাবেন না। নরম বালিশ ব্যবহার করবেন। ঘুম ভাঙার পর পাশ ফিরে উঠবেন। সোজা উঠতে গেলে মেরুদণ্ডে চাপ পড়তে পারে। যারা দীর্ঘসময় বসে কাজ করেন, তারা ঘাড় বা পিঠ বেঁকিয়ে বসার অভ্যাস ত্যাগ করুন। টানা বসে কাজ করবেন না। মাঝে মাঝে উঠে হাঁটাহাঁটি করুন।
টয়লেট ব্যবহার : সাধারণ টয়লেট ব্যবহার না করে হাই কমোড ব্যবহার করুন।
এই রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন-সেবা গ্রহণ করতে হয়।
ডা. মশিউর রহমান খসরু
এমবিবিএস, এমএসসি (রিউম্যাটোলজি, ইউকে)
এফসিপিএস, এফসিআর, ইসিআরডি
সহযোগী অধ্যাপক ও কো-অর্ডিনেটর
রিউম্যাটোলজি রিহ্যাব ক্লিনিক
মাস্কুলোস্কেলেটাল মেডিসিন অ্যান্ড
ইন্টারভেনশনাল ফিজিয়াট্রি ডিভিশন
ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ফিজিয়াট্রিস্ট ও রিউম্যাটোলজিস্ট
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল