স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে হঠাৎ মৃত্যুর কারণ
-ডা. মো. জাকির হোসেন সরকার
সম্প্রতি ভারতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এ রোগের সবচেয়ে সাধারণ ধরন ‘অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া’য় ভুগেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর মৃত্যুর পর রোগটি নিয়ে কৌতূহল বেড়ে গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কী এই অসুখ, যা রীতিমতো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার ধরন
সাধারণত অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ও সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া, এই দুই ধরনের অ্যাপনিয়া দেখা যায়।
অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া: অনেক সময় অনেকের গলার টনসিল ফুলে যায় বা নাকের ভেতরে মাংসপেশি বড়ো হয়ে যায়। যে স্থূলকায় ব্যক্তিদের ঘাড় ছোটো কিংবা নিচের চোয়াল পেছনে থাকে তাদের শ্বাসনালি ও গলার সংযোগস্থলে মাংসপেশি ফুলে যায়। ঘুমানোর সময় অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ তাদের গলার পেশি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি শিথিল হয়ে আসে। তখন মুখগহ্বরের টাকরা, আলজিভ, জিহ্বা ও টনসিলের মতো অংশগুলোকে ধরে রাখে। ফলে শ্বাস নেওয়ার পথটি রুদ্ধ হয়ে আসে এবং ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়।
অ্যাপনিয়া রোগের এই ধরনটিই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটি অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণও বটে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া: নার্ভাস সিস্টেমে জটিলতা হলেও স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। অনেক সময় হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর সমস্যার জন্য কারো দেহের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে নানামুখী সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে, যা হয়ে ওঠে স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণ।
স্লিপ অ্যাপনিয়া মানসিক
স্বাস্থ্যের ওপরও প্রবল
প্রভাব ফেলে
উপসর্গ
এই রোগে আক্রান্তদের ঘুমের স্বাভাবিক সাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সারা দিন ধরে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, বিষণ্ণ বোধ হয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে দেহের বিভিন্ন অংশের ওপরও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। কিডনির সমস্যা, মস্তিষ্কের রোগ, হৃদ্রোগসহ অন্যান্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রবল প্রভাব পড়ে। সাধারণত যেসব উপসর্গ লক্ষ করা যায়, তা হলো –
- সশব্দে নাক ডাকা।
- রাতের বেলায় বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া।
- ঘুমানোর সময় শরীর ঘেমে যাওয়া।
- গলা-মুখ শুকিয়ে যাওয়া।
- সকালের দিকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা।
- নিদ্রাহীনতা।
- সারা দিন ঘুম ঘুম ভাব।
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
- কাজে-কর্মে অমনোযোগিতা।
কেন হয় এই রোগ
দেহের অতিরিক্ত ওজনকে এই রোগের প্রধান কারণ মনে করা হয়। নাক-কান-গলার গঠনগত ত্রুটির কারণেও এটি হয়ে থাকে। স্থূলকায় ব্যক্তিদের জিহ্বায় বাড়তি চর্বি জমে জিহ্বা মোটা হয়ে যায়, অনেকের ঠোঁট পুরো হয়ে যায়, তখন অ্যাপনিয়া হতে পারে। টনসিলাইটিস বা সাইনোসাইটিসের সমস্যার জন্যও এ রোগ হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি
সাধারণত নারীদের তুলনায় পুরুষরা অধিক ঝুঁকিতে থাকেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। নিম্নোল্লিখিত ব্যক্তিগণের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি।
- অতিরিক্ত স্থূলকায় ব্যক্তি।
- নাক ও গলার সমস্যায় ভুগছেন যারা।
- যাদের গলা বা গ্রীবার গঠন সরু।
- যারা ধূমপান করেন।
- যারা মদ বা অন্যান্য নেশাজতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন।
- উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ বা মস্তিষ্কের রোগে ভুগছেন এমন ব্যক্তি।
নাক ডাকলেই কি স্লিপ অ্যাপনিয়া?
নাক ডাকলেই কেউ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত এ কথা বলা যায় না। কারো কারো শোয়ার ভঙ্গিতে অসঙ্গতির কারণে নাক ডাকার সমস্যা হয়। আবার মৌসুমি সর্দিতে আক্রান্ত হয়েও নাক ডাকতে পারেন কেউ। ফলে নাক ডাকা মানেই স্লিপ অ্যাপনিয়া নয়। তবে যারা স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত, তারা সাধারণত ঘুমানোর সময় নাক ডাকেন।
প্রতিরোধে নির্দেশনা
- উচ্চতা অনুযায়ী দেহের ওজন অর্থাৎ বিএমআই বজায় রাখুন।
- সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
- নিয়মিত শরীরচর্চা করবেন।
- নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন নিশ্চিত করুন।
ডা. মো. জাকির হোসেন সরকার
এমবিবিএস, ডিটিসিডি, এমডি (চেস্ট)
সহযোগী অধ্যাপক
রেসপিরেটরি মেডিসিন
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
সিনিয়র কনসালট্যান্ট
পালমনোলজি অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিন
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল