হাড়ের রোগ অস্টিওপোরোসিস : প্রতিরোধে করণীয়
ডা. মো. জিয়া উদ্দিন
হাড়ের ক্ষয়রোগ অস্টিওপোরোসিস। এ রোগে আক্রান্ত হলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। ফলে হাড়ের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়। এতে হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অস্টিওপোরোসিসে কোমরের হাড়, মেরুদণ্ড, হাঁটু ও হাতের কবজির হাড় ভাঙার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। পুরুষদের তুলনায় নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। নারীদের মেনোপজের পর অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যান্য রোগের মতো শুরুতেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ধীরে ধীরে হাড় ক্ষয় হয়, কিন্তু বোঝা যায় অনেক পরে৷ এ জন্য এ রোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অস্টিওপোরোসিস কী
মানুষের শরীরে হাড়ের কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়াই হলো অস্টিওপোরোসিস। আমাদের শরীরে যে হাড় থাকে, তা ওপর থেকে দেখে মসৃণ মনে হয়। কিন্তু মাইক্রোস্কোপের নিচে আনলে দেখা যাবে, আমাদের হাড়ের দেয়ালে অসংখ্য ছিদ্র আছে। যাদের হাড়ের ঘনত্ব ভালো তাদের হাড়ের ছিদ্রগুলো অনেক ছোট হয়। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি ও হরমোনের ঘাটতিজনিত নানা সমস্যায় হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় পাতলা হয়ে যায় ও হাড়ের ছিদ্রগুলো বড় হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে হাড়ে থাকা খনিজ উপাদানগুলো দ্রুত কমতে থাকে। ফলে শরীরের হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষয় হতে থাকে। একসময় অল্প আঘাতেই ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, যাকে অস্টিওপোরোসিস বলে।
অস্টিওপোরোসিস কেন হয়
প্রধানত, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির অভাবে অস্টিওপোরোসিস হয়। এ ছাড়া আরও যেসব কারণে এ রোগ হতে পারে—
- হরমোন কমে যাওয়া।
- ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া।
- প্রোটিনযুক্ত খাবার কম খাওয়া।
- স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন।
- দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা।
- ধূমপান, মদ্যপান ও অতিরিক্ত চা-কফি পান করা।
- শারীরিক পরিশ্রম কম করা।
- পরিবারের কোনো সদস্যের হাড়ক্ষয় রোগ থাকা।
এ ছাড়া যাদের ক্যানসার, থাইরয়েড, অপুষ্টিজনিত রোগ, কিডনি রোগ ও বাতজনিত রোগ আছে তাদের অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
লক্ষণ ও উপসর্গ
হাড়ের ব্যথা বা অল্প আঘাতে হাড় ভেঙে যাওয়া অস্টিওপোরোসিসের প্রধান লক্ষণ। এ ছাড়া—
- শরীরের উচ্চতা কমে যাওয়া।
- কোমর বা শরীরের কোনো অংশে সব সময় ব্যথা অনুভব করা।
- মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙার ফলে কোমরের হাড়ের গঠন পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
- পেশিশক্তি কমে যাওয়া।
- পিঠের পেছনে ব্যথা অনুভব করা।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীদের অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়
চল্লিশোর্ধ্ব নারীরা অস্টিওপোরোসিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীদের দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে, মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে অর্থাৎ মেনোপজের পর এটি বেশি হয়। ইস্ট্রোজেন হরমোন হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে। মেনোপজের পর এই হরমোনের পরিমাণ কমতে থাকে। আর হরমোন কমে গেলে রক্তে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির অভাব দেখা দেয়। এ অভাব পূরণ করতে ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম হাড় থেকে রক্তে চলে আসে। ফলে শরীরে এ দুটি উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির অভাবে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়; শুরু হয় হাড়ক্ষয়। ফলে মেনোপজের পর হাড়ে সামান্য আঘাত লাগলে তা সহজেই ভেঙে যায়।
অস্টিওপোরোসিস শনাক্তকরণ
বিভিন্ন বয়সে হাড়ের ঘনত্বের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হলে এই ঘনত্বের মাত্রার পার্থক্য ঘটে। সাধারণত কোমর ও মেরুদণ্ডের হাড়ের ঘনত্ব ডিস্ক স্ক্যানের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় এবং তা থেকে হাড় ভাঙার ঝুঁকি নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া হাড় ভাঙার আগেই সঠিক সময়ে অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত করার জন্য বোন মিনারেল ডেনসিটি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। অস্টিওপোরোসিসে হাড়ের সাদাভাব কমে যায়, হাড়ের টিউবের দেয়াল পাতলা হয়ে যায় যা এক্স-রের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়।
অস্টিওপোরোসিসের চিকিৎসা
অস্টিওপোরোসিসের চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো হাড় ভাঙার ঝুঁকি কমানো। এ ক্ষেত্রে ডিস্ক স্ক্যানে অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত হলে অস্টিওপোরোটিক ড্রাগ দেওয়া হয় রোগীকে। মেনোপজ, হিস্টেরেকটমির পর নারীদের এই রোগ হলে চিকিৎসার জন্য হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। ইস্ট্রোজেন হরমোনের কাজ করে এমন ড্রাগও দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ রোগের চিকিৎসায় সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়ামজাতীয় ট্যাবলেট, বিসফসফোনেট ইবানড্রোনিক এসিড, জোলেনড্রোনিক অ্যাসিডজাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়, যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিরোধে করণীয়
অন্য অনেক রোগের মতোই অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য—
- প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন— দুধ, দই, পনির, মাখন, সয়াবিন, ছোলা, বাদাম, ইত্যাদি রাখুন।
- পর্যাপ্ত প্রোটিনজাতীয় ও আঁশযুক্ত খাবার খান।
- সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খান।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- অতিরিক্ত তেল-চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- ভিটামিন-ডির অভাব পূরণে প্রতিদিন কিছু সময় সূর্যের আলোতে থাকুন, নির্দিষ্ট পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম ও ডিমের কুসুম খান।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম বা যে কোনো শারীরিক পরিশ্রম করুন।
ডা. মো. জিয়া উদ্দিন
এমবিবিএস, ডি-অর্থো,
এমএস (অর্থো সার্জারি) অর্থোপেডিক ও ট্রমা
হাড় ও জয়েন্ট বিশেষজ্ঞ এবং স্পাইন সার্জন
প্রাক্তন কনসালট্যান্ট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট,
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল