হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর :সচেতন হোন

হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর :সচেতন হোন

অধ্যাপক ডা. মোঃ আব্দুল কাদের আকন্দ

হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর—হৃদ্‌রোগের দুটি আলাদা ধরন। দুটি যে ‘আলাদা’, তা অনেকেই বুঝতে পারেন। কিন্তু আদতে কীভাবে ‘আলাদা’ বা পার্থক্য যে কী—তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন না। ফলে এই দুইয়ের কোনোটিতে আক্রান্ত হলে রোগী প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশয়ে পড়ে যান। এতে সময় নষ্ট হয়, ভুল চিকিৎসার আশঙ্কা তৈরি হয়, যার ফলে রোগী ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়েন। কখনো কখনো মৃত্যুমুখেও পতিত হন।

পার্থক্য না জানলে যে জটিলতা হতে পারে

পার্থক্য বুঝতে না পারার ফলে ঠিক কী ধরনের জটিলতা হতে পারে, তা একটু খোলাসা করে বলা যাক।

চিকিৎসায় দেরি :

  • হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে দরকার হয় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। রোগী হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছেন—ব্যাপারটি যত দ্রুত নির্ণয় করা যাবে, হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তত কমে যাবে এবং একই সঙ্গে বেড়ে যাবে নিরাময়ের সম্ভাবনা। কিন্তু একে হার্ট ফেইলিওরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলে বড় ধরনের জটিলতা হতে পারে।
  • হার্ট ফেইলিওরের ব্যাপারটি ঘটে ধীরে ধীরে। একসময় তা গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়। দরকার হয় দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। ফলে আক্রান্ত হওয়ার শুরুতেই সঠিকভাবে নির্ণয় করে নির্দিষ্টভাবে হার্ট ফেইলিওরের চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে পরিস্থিতি একেবারে নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। হৃদ্‌রোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নতুন নতুন জটিলতা।

ভুল চিকিৎসা :

  • হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর—দুটির চিকিৎসাই আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভুলবশত একটির ক্ষেত্রে অন্যটির চিকিৎসা করা হলে তা তো ফলপ্রসূ হবেই না, বরং ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, হার্ট ফেইলিওর ভেবে ওষুধ গ্রহণ করলে হার্ট অ্যাটাক আরো খারাপ অবস্থায় চলে যায়।

উদ্বেগ ও মানসিক চাপ :

  • দুটিকে গুলিয়ে ফেলায় প্রাথমিক চিকিৎসা যখন ব্যর্থ হয়, তখন আক্রান্ত ব্যক্তিসহ আশপাশের সবাই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন রোগী। ফলে রোগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

প্রতিরোধপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত :

  • দুটি আলাদা রোগ। স্বাভাবিকভাবেই দুটির প্রতিরোধব্যবস্থাতেও আছে বেশ কিছু পার্থক্য। ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য জটিলতা এড়াতে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হয়। সুতরাং যথাযথ রোগ নির্ণয়ে ভুল হলে হৃদ্‌রোগ একপর্যায়ে গুরুতর হয়ে যেতে পারে।

হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর : মূল পার্থক্য কী

হার্ট অ্যাটাক : সারা দেহে রক্ত সরবরাহের জন্য হৃৎপিণ্ডের দরকার হয় রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ। কোনো কারণে হৃৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, চর্বি জমলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই ব্যাপারটিই হার্ট অ্যাটাক, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বলা হয়।

হার্ট ফেইলিওর : বাংলায় একে হৃৎপিণ্ড বিকল, আরো সহজ করে বললে, হৃদ্ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া বলা যায়। অর্থাৎ এ অবস্থায় হৃদ্ যন্ত্র তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হৃদ্ যন্ত্রের কাজ হচ্ছে রক্ত পাম্প করে সারা দেহে রক্তের জোগান দেওয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেহের অন্যান্য অঙ্গ ও কোষকলা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পেয়ে থাকে। নানা কারণে হৃদ্ যন্ত্র দুর্বল হয়ে গেলে তখন তার রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে একসময় অকার্যকর হয়ে যায়। এ অবস্থাকেই বলে হার্ট ফেইলিওর।

হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর : কারণেও আছে ভিন্নতা

হার্ট অ্যাটাক : এর মূল কারণ মূলত রক্তনালি বন্ধ হয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া। এটি হলে তাৎক্ষণিকভাবে হার্ট তার কাজ করতে ব্যর্থ হয়, যার পরিণতিতে হয় হার্ট অ্যাটাক। ধূমপানের অভ্যাস, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, স্থূলতা প্রভৃতি কারণে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

হার্ট ফেইলিওর : নানা কারণে হৃৎপিণ্ড যখন দুর্বল হয়ে যায় এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হারায় তখন হৃৎপিণ্ড বিকলের ঘটনা ঘটে। হার্ট অ্যাটাক হার্ট ফেইলিওরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বসংকেত। মূলত হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন ধরনের জটিলতার চূড়ান্ত রূপ হার্ট ফেইলিওর। এর উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • করোনারি আর্টারি ডিজিজ।
  • উচ্চ রক্তচাপ।
  • হার্টের ভালভে ত্রুটি।
  • কার্ডিওমায়োপ্যাথি (হার্টের পেশির ক্ষতি)।
  • মায়োকার্ডাইটিস (হার্টের পেশির প্রদাহ)।
  • হার্টের জন্মগত ত্রুটি।
  • অ্যারিথমিয়া (অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন)।
  • ডায়াবেটিস, এইচআইভির মতো ক্রনিক রোগ।

হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওরের উপসর্গগত পার্থক্য

উভয় রোগের ক্ষেত্রে শীত লাগা, ঘাম হওয়া, বমিভাব, বমি, মাথা ঘোরা বা ক্লান্তির মতো অনেকগুলো উপসর্গে মিল থাকায় রোগীর বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে কয়েকটি বিষয় সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে অনেক সময় পার্থক্য বোঝা যায়। যেমন—

  • হার্ট অ্যাটাকের প্রধান উপসর্গ হচ্ছে বুকে ব্যথা। সেই সঙ্গে বুকে চাপ লাগার মতো অনুভূতি হয়। ব্যথা মৃদুভাবে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ছড়িয়ে যায় হাত, ঘাড়সহ অন্যান্য অঙ্গে।
  • অন্যদিকে হার্ট ফেইলিওরের প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। হার্ট ফেইলিওর হলে ফুসফুস অক্সিজেন পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করা শুরু করে। একসময় মনে হয় দম ফুরিয়ে আসছে। এ অবস্থায় ঝিমঝিম ভাব হয়। স্মৃতিবিভ্রাট ঘটে। নখ ও ঠোঁট নীল হয়ে যেতে পারে।

ঝুঁকি এড়াতে চাই সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা

হৃদ্‌রোগ মোকাবিলায় প্রধানত দরকার সচেতনতা এবং এ রোগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওরের পার্থক্য নির্ণয় করার মতো সাধারণ জ্ঞান থাকলে ভুল চিকিৎসার আশঙ্কা যেমন কমবে তেমনই এড়ানো যাবে বড় কোনো ক্ষতি।


অধ্যাপক ডা. মোঃ আব্দুল কাদের আকন্দ

এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (কার্ডিওলজি),
এফএসিসি (ইউএসএ)
মেডিসিন ও হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ
ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিওলজি (অব.)
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp