হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যাথা

-অধ্যাপক ডা. এম. আমজাদ হোসেন

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আশরাফ হোসেন। বয়স ৭৫ বছর। সকাল-বিকেল ছাদে ফুল ও সবজির বাগান পরিচর্যা আর নাতি টুটুলের সঙ্গ—সবমিলিয়ে অবসর নেওয়ার পর বেশ আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ইদানীং মাঝে মাঝেই দেখা দিচ্ছে হাঁটুর ব্যথা। ছাদে উঠবেন দূরের কথা, একটা-দুটো সিঁড়ি ভাঙলেই শুরু হয় হাঁটুর জোড়ায় চিনচিনে ব্যথা।

মানুষের বয়স বাড়লে হাড়েরও তো বয়স বাড়ে। অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার পরিবর্তন হয়। কোথাও কোথাও হাড়ের আকৃতিরও পরিবর্তন হয়। নানা রকম রোগ দেখা দেয়। হাড় ও জয়েন্টে ব্যথা হয়। হাড়ব্যথা কোনো রোগ নয়, এটি নানা রোগের উপসর্গ। সাধারণত চল্লিশোর্ধ মহিলা ও পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ বার্ধক্যজনিত কারণে হাড় জোড়ার ব্যথায় ভুগে থাকেন। তবে যেকোনো বয়সের মানুষেরই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথার উপসর্গ

সাধারণত বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রম কমে আসে। ফলে হাড়ের রোগবালাই বেড়ে যায়। এ সময় মাংসপেশির আকার ও হাড়ের ঘনত্বও কমে আসে। একই স্থানে বারবার আঘাত লাগা ও হাড় ভাঙার প্রবণতাও দেখা যায়।

এ ধরনের সমস্যায় হাড়ের জোড়ায় ব্যথা ও ব্যথার স্থান ফুলে যাওয়া, ভাঁজ করতে অসুবিধা, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভাঁজ করার সময় শব্দ হতে পারে। এছাড়া আরো যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে—

  • নড়াচড়া করলে ব্যথা বা অস্বস্তি হওয়া
  • আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে
  • মাংসপেশি ও টিস্যুতে ব্যথা
  • ঘুমের অসুবিধা
  • আক্রান্ত স্থানের আকৃতি পরিবর্তন
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • বুক, মাথা ও পিঠে ব্যথা
  • দ্রুত ওজন কমতে থাকা
  • হাড় ভেঙে যাওয়া
  • খিঁচুনি, জন্ডিস দেখা দেওয়া
  • বমিভাব
  • ক্ষুধামান্দ্য
হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া
স্টেরয়েড বা ব্যথানাশক
ওষুধ সেবন করবেন না

হাড় ব্যথার কারণ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা নানা কারণে হয়ে থাকে। কী কারণে ব্যথা হচ্ছে তা জানা জরুরি। আঘাত ও বাতজনিত কারণে যেকোনো বয়সেই অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাড়ের পরিবর্তন জনিত কারণে বেশি ব্যথা হতে দেখা যায়। ব্যথাসংক্রান্ত যেকোনো লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ামাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর রক্ত, ইউরিক অ্যাসিড, ডায়াবেটিস প্রভৃতি পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও এমআরআই, সিটিস্ক্যান, ক্যানসার নিশ্চিতকরণে ক্যানসার মার্কার, হাড়ের এক্স-রে প্রভৃতি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।

যেসব কারণে হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা হতে পারে-

  • বংশগত কারণে
  • ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে
  • ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গেলে
  • ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েডিজমের সমস্যা থাকলে
  • অস্টিওপোরোসিস, রিউমাটয়েড ও অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে
  • কম বয়সে গেঁটে বাতের সমস্যা দেখা দিলে
  • হাড়ে আঘাত পেলে
  • হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে.
  • ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য অপুষ্টিজনিত সমস্যা থাকলে

হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা চিকিৎসা

হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যাথা

হাড়ের ব্যথার কারণ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। আক্রান্ত স্থান পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে।

অতিরিক্ত নরম বিছানায় ঘুুমাবেন না। বিছানায় শোয়া ও ওঠার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে হাতের ওপর ভর দিন। মেরুদণ্ড ও ঘাড় নিচু করে কোনো কাজ করবেন না। মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যথার স্থানে ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে।

ব্যথার স্থানে কোনো ধরনের মালিশ করবেন না। প্রদাহ হলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। ব্যথা কমে গেলেও ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। হাড় ভেঙে গেলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসা প্রতিরোধ

একটু বয়স বাড়লেই হাড় ও জোড়ার ব্যথা দেখা দিতে থাকে। তাছাড়া কাজ বা খেলাধুলা করতে গিয়ে যে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন। হাড়ের এই ব্যথা প্রতিরোধে সচেতনতা ও সাবধানতা বিশেষভাবে জরুরি।

  • দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
  • নিয়মিত তাজা ফল ও শাকসবজি খেতে হবে।
  • নিয়মিত ভিটামিন-সি, ই, ডি ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি।
  • পেশি সচল রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
  • বিশেষজ্ঞের নির্দেশনামতো ব্যায়াম করবেন। ব্যথা বাড়লে ব্যায়াম বন্ধ রাখবেন।
  • চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন।
  • ব্যথা বেশি হলে হাই কমোড ব্যবহার করুন।
  • উঁচু জুতো পরার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
  • ব্যথা কমে গেলে নিয়মিত হাঁটুন। শরীর সচল রাখুন।
  • ব্যথা উপশমে নিজে নিজে ব্যথার ওষুধ সেবন করবেন না।
হাড় ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা

ডা. এম. আমজাদ হোসেন
অধ্যাপক ডা. এম. আমজাদ হোসেন

এমএস (অর্থো), এও ফেলো (জার্মানি)
হ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন (মাদ্রাজ), কোমর ও হাঁটু সার্জারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত)
প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
চিফ কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp