হিপ ও নি প্রতিস্থাপন

হিপ ও নি প্রতিস্থাপন

হাঁটু ও কোমর—আমাদের দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই অঙ্গগুলোর কোনোটিতে সমস্যা হলে পুরো দেহে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। আঘাতজনিত কারণে যেমন এ ব্যথা হতে পারে, আবার বিভিন্ন রোগের ফলেও হতে পারে। ধরনভেদে ব্যথা স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার ক্ষেত্রে অঙ্গগুলোর কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পেতে একসময় অঙ্গবিকলের ঝুঁকি তৈরি হয়। এমতাবস্থায় রোগীর নড়াচড়া, হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ না হলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দরকার হতে পারে।

হিপ প্রতিস্থাপন

হিপ বলতে ঠিক কোমরকে বোঝায় না। মূলত ঊরুর হাড়ের (ফিমার) উপরিভাগ এবং নিতম্বের কোটরের সংযোগস্থলকে সমন্বিতভাবে হিপ বলা হয়। হাঁটাচলা, অর্থাৎ সম্পূর্ণ পায়ের স্বাধীন নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হয় হিপের মাধ্যমে।

যে কারণে হিপ প্রতিস্থাপন করা হয়

  • রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস
  • কোমরে আঘাত
  • কোমরের হাড় ক্ষয়
  • হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
  • হাড় ভেঙে যাওয়া বা সরে যাওয়া
  • হাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
  • হাড়ের টিউমার
  • অস্থিতে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হওয়া

হিপ প্রতিস্থাপন কী

উপর্যুক্ত যেকোনো কারণে হিপ ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর হয়ে গেলে হিপ প্রতিস্থাপনের দরকার হতে পারে। এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অকার্যকর হিপ ফেলে দিয়ে কৃত্রিম হিপ প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ঊরুর হাড়ের মাথা ও সামনের দিকের কিছু অংশ এবং নিতম্বের কোটর কেটে সেখানে ধাতব বা প্লাস্টিক-নির্মিত কৃত্রিম
হিপ স্থাপন করা হয়।

যাদের করা হয়

সাধারণত বয়স্ক মানুষদেরই হিপ প্রতিস্থাপনের দরকার হয়। এছাড়া যারা কায়িক পরিশ্রম কম করেন, হাঁটাচলা করেন না কিংবা স্থূলদেহী—তাদের ক্ষেত্রেও হিপ রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে। আবার যেসব নারী বা পুরুষ একই ভঙ্গিতে বসে বা দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করেন কিংবা যেসব নারী হাঁটু ভাঁজ করে পিঁড়িতে বসে ঘরের কাজ করেন তাদেরও কোমর ব্যথা হয় এবং প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ সেবন করলেও এর ঝুঁকি বাড়ে।
নি (হাঁটু প্রতিস্থাপন)

আঘাত বা কোনো রোগের কারণে হাঁটুর হাড় বা অস্থিসন্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জটিলতা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে হাঁটু প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সার্জারির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হাঁটু অপসারণ করে ধাতব বা প্লাস্টিকের কৃত্রিম হাঁটু স্থাপন করাকে হাঁটু প্রতিস্থাপন বলা হয়।

যেসব কারণে হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়

  • অস্টিওআর্থ্রাইটিস
  • রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস
  • জয়েন্ট স্টিফনেস
  • ট্রমাটিক নি
  • জয়েন্ট ডেস্ট্রাকশন

হাঁটুর এই সমস্যাগুলো সাধারণত ওষুধে ভালো হয় না। উপরন্তু ব্যথানাশক ওষুধ কিডনির রোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি তৈরি করে। এক্ষেত্রে অনিবার্য হয়ে ওঠা টোটাল নি রিপ্লেসমেন্ট খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীকে ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।

যাদের করা হয়

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুতে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। অধিক স্থূল শরীর যাদের তারাও হাঁটুর জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আঘাতজনিত কারণে অনেকের হাঁটুতে অসুবিধা হয়। হাঁটু স্টিফ হয়ে যায়। হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। এমন অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটু প্রতিস্থাপনের দরকার হতে পারে।

হাঁটু প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত উপাদান

কৃত্রিম হাঁটুর নিচের অংশ তৈরি হয় ধাতব পাত বা তন্তুর সাহায্যে। সার্জন এটিকে পায়ের নিচের দিকের টিবিয়াল বোনের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। টিবিয়াল ট্রে রঙিন কোবাল্ট বা টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি। এটি বোন সিমেন্ট দিয়েও যুক্ত করা যায়।

প্রতিস্থাপিত হাঁটুর ওপরের অংশও একধরনের ধাতব পাত দিয়ে তৈরি। এটি ঊরুর হাড়ের (ফিমার) নিচের অংশ ঘিরে বসানো হয়। ভেতরের অংশ বোন সিমেন্ট অথবা প্রাকৃতিকভাবে হাড় বৃদ্ধি পেয়েও পূরণ হতে পারে। পুরো ধাতব আবরণ এমনভাবে তৈরি যাতে সন্ধিতে স্থাপিত প্যাটেলা সহজে নড়াচড়া করতে পারে। এর ফলে পা অবলীলায় ওঠানো ও নামানো যায়।

প্রতিস্থাপন-পরবর্তী ঝুঁকি ও যত্ন

প্রতিস্থাপনের পর উক্ত স্থানে সংক্রমণ হতে পারে। কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ফলে দেহে বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। ফলে এ সময় খুব সচেতন থাকা জরুরি। অস্ত্রোপচারের পরের দিন থেকেই ফিজিওথেরাপি দেওয়া যায়। হিপ বা নি প্রতিস্থাপনের পর চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্র্যাচ বা ওয়াকার ব্যবহার করতে হবে। অস্ত্রোপচারের পর কিছুদিন দুই পায়ের মাঝে বালিশ বা কুশন রাখবেন। এতে কৃত্রিম অঙ্গ ঠিকভাবে বসার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

আধুনিক চিকিৎসাজগতে হিপ, নি প্রতিস্থাপন সার্জারি একদমই সুলভ একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। আমাদের দেশেও এর বিশ্বমানের চিকিৎসা হয়ে থাকে। যারা কোমর বা হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন তারা সমস্যাটি নিয়ে বসে থেকে নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি ডেকে আনবেন না। বরং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং প্রয়োজনে সার্জারি করে কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করুন।


অধ্যাপক ডা. এম. আমজাদ হোসেন

অধ্যাপক ডা. এম. আমজাদ হোসেন

চিফ কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান
আর্থোপ্লাস্টি ও ট্রমা সার্জন
ল্যাবএইড হাসপাতাল লিঃ
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp