ডা. নূর মোহাম্মদ
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশই হয় হৃদরোগের ফলে। কোভিড-১৯ এর শুরু থেকেই হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের অধিক সতর্ক থাকার জন্য বলা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ একজন কমবয়সী ও সুস্থ সবল মানুষ যতখানি সামলে নিতে পারেন, হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে তা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণে এ পর্যন্ত যাদের মৃত্যু হয়েছে, দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিল। এ সময়ে হৃদরোগীদের ঝুঁকি বেশি থাকার একটি বড়ো কারণ হচ্ছে, করোনাভাইরাস সরাসরি হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে। এটি তিন থেকে চার ভাবে হতে পারে। এর মধ্যে মায়োকার্ডাইটিসের কারণে প্রদাহ অন্যতম। এটি প্রথমে ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গকে সংক্রমিত করে, পরে হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করে। আর এ থেকেই কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া বা অ্যাকিউট কার্ডিয়াক ইনজুরি হতে পারে।
করোনায় হৃদরোগীদের ঝুঁকি
করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর হৃদরোগীরা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এর মধ্যে বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাট্যাক, মায়োকার্ডাইটিস, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন অন্যতম। আবার করোনামুক্ত হৃদরোগীদেরও কিছু পোস্টকোভিড সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। যেমন- বুকে ব্যথার সমস্যা বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া, পেটে ব্যথা ইত্যাদি।
এ সময়ে হৃদরোগীদের ঝুঁকি বেশি থাকার একটি বড়ো কারণ হচ্ছে,
করোনাভাইরাস সরাসরি হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে।
কাদের ঝুঁকি বেশি
এ সময়ে যেসব হৃদরোগীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো তাদের ঝুঁকি অন্য সবার মতোই। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম কিংবা জটিল হৃদসমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য বিষয়টি ভয়ের। করোনায় যেসব হৃদরোগী অধিক ঝুঁকিতে আছেন-
- যাদের হার্ট পাম্প করার ক্ষমতা কম।
- যাদের পেসমেকার বসানো আছে কিংবা ভালভের অপারেশন হয়েছে।
- স্টেনটিং ও বাইপাস সার্জারি হওয়া ব্যক্তি।
- যে সমস্ত হৃদরোগীর হৃদরোগের পাশাপাশি ওজনজনিত সমস্যা, থায়রয়েড সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ আছে।
- যেসব হৃদরোগীদের জীবনযাপন অনিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ যাদের রাত জাগা, ধূমপান ও মদ্যপান ইত্যাদির অভ্যাস আছে।
সুস্থ থাকতে করণীয়
যদি কিছু বিষয়ে সচেতন থাকা যায় তবে কোনো হৃদরোগী করোনা আক্রান্ত হলেও তার স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকে। যেমন-
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার
শরীর সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। আর হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় বিশেষ ভ‚মিকা রাখে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার। বিভিন্ন ধরনের বীজ, যেমন- মিষ্টি কুমড়া ও শিমের বিচি, সূর্যমুখী ফুলের বীজ, পেঁয়াজ, বিভিন্ন
ধরনের বাদাম, আপেল, চর্বিবিহীন মাংস, মধু, ডার্ক চকলেট, পালং শাক, ক্যাপসিকাম, গাজর ব্রকলিসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চা তে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে।
ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত ১৬ শতাংশ মানুষই হৃদরোগে মারা যান। পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরোল বেড়ে যাওয়া, ধূমপান, স্থ‚লতা এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপের অভাবে হৃদরোগীর ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেকখানিই। এ সময়ে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
নিয়মিত শরীরচর্চা
অলস জীবনযাপনের ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। আর যারা ইতোমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের জন্য এটি আরো বিপজ্জনক। করোনা মানুষকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে, কমিয়ে দিয়েছে ঘরের বাইরের কার্যকলাপ। তাই ঘরের মধ্যেই প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় শরীরচর্চা করতে হবে।
যারা এ সময়ে হোম অফিস করছেন, তারা একটানা বসে না থেকে মাঝে মাঝে হাঁটাচলা করবেন।
সংক্রমণ প্রতিরোধ
‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’- এ কথাটি করোনাভাইরাসের জন্য খুব ভালোভাবে প্রযোজ্য। সবকিছু মেনে চলার পরেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়। হৃদরোগীদের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই সবচেয়ে ভালো হয়, যদি সংক্রমণ এড়ানো যায়। সেজন্য মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ব। বেশি বেশি সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। মাস্ক ছাড়া বাইরে যাওয়া চলবে না। নাকে-মুখে-চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
মানসিক চাপ কমাতে হবে
গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আর এ সময়ে করোনাভীতি, পারিপার্শ্বিকতা, গৃহবন্দী জীবনযাপন, প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কা এবং সর্বোপরি হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মানসিক চাপে থাকেন; যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই এ সময়ে যতটা সম্ভব মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করতে হবে।
নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন
আগেই বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা আবশ্যক। রাত জাগার অভ্যেস পরিত্যাগ করতে হবে। ডিভাইস আসক্তি, ফাস্টফুড খাওয়া কমাতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যেস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে।
ডা. নূর মোহাম্মদ
এমবিবিএস; ডি-কার্ড (সিইউ)
এমসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (ইন্টারনাল মেডিসিন) বিএসএমএমইউ
মেডিসিন এন্ড হার্ট স্পেশালিস্ট
কনসালট্যান্ট (মেডিসিন, ক্লিনিকাল এন্ড ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি)
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা