হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় বাইপাস সার্জারি

হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় বাইপাস সার্জারি

ডা. লুৎফর রহমান

হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর আধুনিক একটি চিকিৎসাপদ্ধতি করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি। সর্বসাধারণের কাছে অবশ্য এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘বাইপাস সার্জারি’ই অধিক পরিচিত। বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য এটি করা হয়।

বাইপাস সার্জারি কী

হৃৎপিণ্ড আমাদের সারা দেহে রক্ত সরবরাহের কাজ করে। এই কাজের জন্য দরকার হয় রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ, যা সে পেয়ে থাকে তার চারপাশে জড়িয়ে থাকা রক্তসঞ্চালক ধমনিগুলোর মাধ্যমে। এই ধমনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা এগুলোতে ব্লকেজ তৈরি হলে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। তখন হৃৎপিণ্ড যথাযথভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না। এ অবস্থায় রক্ত চলাচল নির্বিঘ্ন করতে চিকিৎসক অতিরিক্ত ধমনি বা শিরার ব্যবহার করেন। এই সুস্থ ধমনি বা শিরা নেওয়া হয় রোগীর বুক, হাত, পা বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে। এরপর তা রোগীর অবরুদ্ধ বা চর্বিযুক্ত ধমনিতে সংযুক্ত করে দেন। এতে হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচলের জন্য নতুন পথ তৈরি হয়। এই পদ্ধতিকেই বলা হয় বাইপাস সার্জারি।

কোন পরিস্থিতিতে বাইপাস সার্জারি করা হয়

সাধারণত ওষুধ, বিভিন্ন থেরাপি, শরীরচর্চা, ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদ্‌রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। বড়জোর অ্যানজিওপ্লাস্টি করে স্টেন্ট বসিয়ে চিকিৎসক রোগীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। তবে পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল অবস্থায় চলে গেলে বাইপাস সার্জারিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে নিরাপদ চিকিৎসা। বিশেষত আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক হলে অথবা অদূর ভবিষ্যতে হার্টের বড় কোনো ঝুঁকির আশঙ্কা থাকলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। নিম্নোক্ত পরিস্থিতি তৈরি হলে বাইপাস সার্জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—

  • হৃৎপিণ্ডের ধমনির বিভিন্ন জায়গায় যদি একাধিক ব্লক তৈরি হয় এবং তা আকারে লম্বা লম্বা হয়।
  • যদি হৃৎপিণ্ডের বাম প্রধান ধমনিতে ব্লকেজ তৈরি হয়।
  • হৃৎপিণ্ডের প্রধান ধমনি যদি বেশি পরিমাণে সংকুচিত হয়ে যায়।
  • হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন ধমনি সরু হয়ে যাওয়ার দরুন যখন তীব্র বুকে ব্যথা হয়। হালকা শরীরচর্চা, এমনকি বিশ্রামের সময়ও এই ব্যথা হয়ে থাকে।
  • ধমনিতে যদি একাধিক রোগ থাকে।
  • যখন করোনারি এনজিওপ্লাস্টি চিকিৎসাও ফলপ্রসূ হবে না বলে মনে করা হয় কিংবা এনজিওপ্লাস্টি করে স্টেন্ট বসানোর পর যদি পুনরায় ধমনি সংকুচিত হয়ে যায়।
  • একাধিক স্টেন্ট বসানো হয়ে গেলে।

বাইপাস সার্জারির সুবিধা

হৃদ্ যন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হিসেবে বর্তমানে বাইপাস সার্জারি সবচেয়ে নিরাপদ ও অধিক ফলপ্রসূ। এই চিকিৎসার কিছু প্রত্যক্ষ সুবিধার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

  • প্রথমেই বলা যেতে পারে এর সফলতা সম্পর্কে। বাইপাস সার্জারির সাফল্যের হার অত্যন্ত ভালো। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যাচ্ছে, বাইপাস সার্জারি রোগীর বেঁচে থাকার হার বাড়িয়ে দেয়। বিশেষত যেসব রোগী করোনারি আর্টারি ডিজিজ ও হার্ট ফেইলিওরের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছেন তাদের ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
  • যাঁদের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির একাধিক জায়গায় একাধিক ব্লক আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাপদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ।
  • সার্জারি-পরবর্তী ফলোআপ পর্যায়ে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টির ঝুঁকি খুবই কম।
  • সার্জারির পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর বুকের ব্যথা প্রায় নিরাময় হয়ে যায়।
  • এতে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং অন্যান্য হৃদ্‌রোগের জটিলতা বা ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। এমনকি এই সার্জারিতে হৃদ্ যন্ত্রের কোনো ধরনের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কম।
  • এতে স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যায়।
  • চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সাধারণ কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে অনায়াসে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।

সার্জারির জন্য রোগীর প্রস্তুতি

বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীর কতগুলো পূর্বপ্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে। যেমন—

  • সার্জারির দুই সপ্তাহ আগে থেকে রক্তসঞ্চালনে তঞ্চনপ্রতিরোধক-জাতীয় (অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট—যা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না) ওষুধ সেবন বন্ধ রাখা
  • জরুরি। কেননা, সার্জারির সময় ও পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে।
  • সার্জারির আগের দিন রাত থেকে রোগীর খাবারদাবারের ব্যাপারে চিকিৎসক কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সেগুলো মেনে চলতে হবে। বিশেষত
  • তরল খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমাতে বা প্রায় বন্ধ করে দিতে বলা হয়।
  • সার্জারির ব্যাপারে রোগীর মানসিক প্রস্তুতিও জরুরি। একদমই ঘাবড়ানো যাবে না বা দুশ্চিন্তা করা যাবে না।
  • ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সার্জারির যত দিন আগে থেকে সম্ভব তা পরিহার করতে হবে।
  • সার্জারির কাছাকাছি সময় জ্বর, ঠান্ডা বা ফ্লু থাকলে তা চিকিৎসককে জানাতে হবে।
  • যেকোনো সংক্রমণ এড়াতে সার্জারির আগে বিশেষ ধরনের সংক্রমণরোধী সাবান দিয়ে গোসল করে নেওয়া ভালো।
  • পর্যাপ্ত সময় নিয়ে হাসপাতালে আসতে হবে। সার্জারির আগে সিবিসি, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, এক্স-রে, সিটি স্ক্যানসহ প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সময় হাতে রাখা জরুরি।

ডা. লুৎফর রহমান

ডা. লুৎফর রহমান

এমবিবিএস, এমএস (সিটিএস)
চিফ কার্ডিয়াক সার্জন,
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp