আইবিএস : বিরক্তিকর পেটের সমস্যা
অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর
আইবিএস খুবই সাধারণ কিন্তু তীব্র অস্বস্তিকর একটি রোগ। পেটের এই সমস্যাটি স্বাভাবিক জীবনযাপনে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে আক্রান্ত হলে খাবার খেয়ে স্বস্তি পাওয়া যায় না। খাওয়ার পরপরই পেটে অস্বস্তি ভাব শুরু হয়। আবার এতে আক্রান্ত হওয়ার পেছনেও খাবারের বিষয়টি রয়েছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এ রোগের একটি প্রধান কারণ। আর নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপন এর জটিলতাগুলো আরো বাড়িয়ে তোলে। মারাত্মক রোগ না হলেও এটি জীবনব্যাপী একটি সমস্যা। তবে আশার কথা হলো, এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আরামদায়ক জীবনযাপন করা যায়।

আইবিএস কী
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস পেটের দীর্ঘমেয়াদি একটি সমস্যা। এটি মূলত আমাদের পরিপাকতন্ত্রের কার্যগত জটিলতা সম্পর্কিত রোগ। তবে, এতে পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত কোনো পরিবর্তন হয় না। আইবিএসে আক্রান্ত হলে বিরক্তিকর পেটের সমস্যা তৈরি হয়। লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য, কখনো ডায়রিয়া। এ সমস্যা সাধারণত যুবক বয়স থেকে দেখা যায়। আর পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে এতে আক্রান্ত হওয়ার হার কিছুটা বেশি।
আইবিএস কেন হয়
- আইবিএস কেন হয়, এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে, কিছু বিষয়ের কারণে এ রোগ হতে পারে। যেমন
- পরিপাকতন্ত্র ও স্নায়ুর মধ্যকার সংকেতজনিত সমস্যা (নিউরো-গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিজঅর্ডার)
- নির্দিষ্ট কিছু খাবারে অসহনশীলতা (ফুড ইনটলারেন্স)
- পরিপাকতন্ত্রের অস্বাভাবিক সংকোচন ও প্রসারণ।
- খাদ্যনালিতে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ।
- পরিপাকতন্ত্রে উপকারী ও অপকারী ব্যাকটেরিয়ার অসামঞ্জস্য।
- অত্যধিক মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা আইবিএস বাড়িয়ে তোলে।

যারা শৈশবে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন, পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আইবিএসের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
আইবিএসের সমস্যা প্রধানত দুইভাবে প্রকাশ পেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে পেটে ব্যথা এর একটি লক্ষণ। মলত্যাগের পর এই ব্যথা অনেকটা উপশমও হয়ে যায়। অন্যটি হলো মলত্যাগের অভ্যাসে ব্যাপক আকারে পরিবর্তন লক্ষ করা। যেমন : টানা পাতলা পায়খানা হতে থাকা ও কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া। কারো ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দুটোই হতে পারে। এ ছাড়াও, আইবিএস খাবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় কিছু খাবার খেলে এটি বাড়তে পারে। যেমন : দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, শাক, ফাস্ট ফুড, পোলাও, বিরিয়ানি, তৈলাক্ত ও মসলাযুক্ত যেকোনো খাবার। ব্যক্তিভেদে আরো কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে—
- মল ত্যাগের পরও পেট পরিষ্কার হয়নি এমন মনে হয়।
- খাবার গ্রহণের পরপরই মল ত্যাগের চাপ অনুভব করা
- মলের সঙ্গে মিউকাস (চর্বিযুক্ত মল) যাওয়া।
- অতিরিক্ত বায়ু ত্যাগ ও ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করা আইবিএসের ধরন
লক্ষণ ও মলের ধরনের ওপর ভিত্তি করে আইবিএসকে বিভক্ত করা যায়। যেমন—
আইবিএস সি : এ ধরনের আইবিএসে পেটব্যথার সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। মলের ধরন শক্ত ও পিণ্ড পিণ্ড হয়ে থাকে।
আইবিএস ডি : মলের আকার পাতলা ও জলযুক্ত হয়ে থাকে এ ধরনের আইবিএসে। পেটব্যথার সঙ্গে ডায়রিয়া হতে থাকে।
আইবিএস এম : আইবিএস মূলত উল্লিখিত এই দুই ধরনের হয়। তবে কখনো একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর দুটি ধরনই দেখা দিতে পারে। যেখানে কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া দুটোই ধারাবাহিক চলতে থাকে। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় আইবিএস এম।
আইবিএস প্রতিরোধে করণীয়
আইবিএসের রোগীরা জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন ও উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। এজন্য প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলতে হয় কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন। যেমন :

- যেসব খাবার খেলে এ সমস্যা বেড়ে যায় তা পরিহার করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, শাক, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও মসলাযুক্ত খাবার সমস্যাটি বাড়িয়ে দেয়।
- সহজে হজম হয়, এমন খাবার খেতে হবে। খাওয়ার সময় খাবারগুলো ভালো করে চিবিয়ে নিবেন।
- পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। তবে, খাবার খাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে পানি না খাওয়া ভালো। খাবার গ্রহণের আগে অথবা কিছুক্ষণ পর পানি পান করতে পারেন।
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদ এ সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। তাই এগুলো কমিয়ে ফেলুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। ঘুমের সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে পারেন।
- নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন। এ সময় পেটের ব্যায়াম করতে পারেন। এগুলো হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।

অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (গ্যাস্ট্রো),
এমএসিজি (ইউএসএ), এফআরসিপি (এডিন)
মেম্বার, ইন্ডিয়ান ও ব্রিটিশ সোসাইটি অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি
মেম্বার, আমেরিকান গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ (প্রাক্তন),
এস, এস, এম, সি ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল