উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন, সুস্থ রাখে শরীর ও মন

সুস্বাস্থ্যের জন্য ওজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আবার ওজন অনেক কম হলেও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে উচ্চতা, বয়স ও লিঙ্গভেদে আদর্শ ওজন বজায় রাখা জরুরি।

আদর্শ ওজন নির্ণয়ের পদ্ধতি

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক ওজন কত হওয়া উচিত তা জানার অন্যতম উপায় হলো বিএমআই নির্ণয়। বিএমআই একটি আন্তর্জাতিক সূচক যার পূর্ণরূপ— বডি ম্যাস ইনডেক্স। এ পদ্ধতিতে উচ্চতা অনুযায়ী প্রত্যেকের আদর্শ ওজন নির্ণয় করা যায়। এক্ষেত্রে ওজন পরিমাপ করা হয় কেজিতে (কি.গ্রা.) এবং উচ্চতা পরিমাপ করা হয় মিটারে। মোট ওজনকে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করে বিএমআই বের করা হয়।

অর্থাৎ, বিএমআই = ওজন (কি.গ্রা.) ÷ উচ্চতা (মিটার)²

বৈশ্বিক হিসাব অনুযায়ী, একজন মানুষের বিএমআই যদি ১৮.৫ থেকে ২৩-এর মধ্যে থাকে তাহলে তার ওজন উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বিএমআই ১৮.৫-এর নিচে হলে তা অস্বাভাবিক কম ওজন বলে গণ্য করা হয়। অপরদিকে এশিয়ান মানুষদের জন্য বিএমআই ২৭.৫ কি.গ্রা./মিটার² বা এর বেশি হলে তা স্থূলতা বা ওবেসিটি।

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার নানা জটিলতা

অতিরিক্ত তেল-মসলা ও চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করা, হরমোনজনিত সমস্যা প্রভৃতি কারণে ওজন আস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে দেহ স্থূলকায় হয়ে পড়ে। শরীরে মেদ-চর্বি জমে। স্থূলতা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। যেমন—

  • ডায়াবেটিস।
  • উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি।
  • হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক ও বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার।
  • ফ্যাটি লিভার ও পিত্তথলিতে পাথর।
  • হাড় ও গাঁটের সমস্যা বা আর্থ্রাইটিস।
  • শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া।
  • ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া।
  • নারীদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম এবং এর ফলে গর্ভধারণে সমস্যা।
  • মানসিক বিষণ্নতা ও উদ্বেগ।

অস্বাভাবিক কম ওজনে স্বাস্থ্য সমস্যা

পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার না খাওয়া, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, দীর্ঘদিন ধরে কোনো রোগে ভোগা—এসব কারণে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যেতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—

  • পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা ও মাংসপেশির দুর্বলতা।
  • হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া বা অস্টিওপোরোসিস।
  • শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া।
  • পুষ্টির অভাবে অন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে হজমে সমস্যা হওয়া। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া।
  • মানসিক অবসাদ।

ওজনজনিত স্বাস্থ্য জটিলতা নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা

ওজনজনিত সমস্যা নির্ণয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম, পুষ্টির ঘাটতি বা অতিরিক্ততা এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতাগুলো শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে বডি ম্যাস ইনডেক্স নির্ণয়ের পাশাপাশি সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের হিমোগ্লোবিনসহ অন্যান্য উপাদানের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। অতিরিক্ত ওজনের কারণে রক্তে কোলেস্টেরল ও শর্করার মাত্রা বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। তাই নিয়মিত লিপিড প্রোফাইল ও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। এছাড়া, লিভার, কিডনি, মূত্রনালি ও হাড়ের জটিলতা শনাক্তে এসজিপিটি, এইচবিএসএজি, ইউরিক অ্যাসিড, সিরাম ক্রিয়েটিনিন এবং ইউরিন আর/এম/ই পরীক্ষাগুলো করা হয়। ভারসাম্যহীন ওজনের প্রভাব পড়তে পারে হৃৎপিণ্ডসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।

উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক ওজন কত হওয়া উচিত

একজন মানুষের স্বাভাবিক ওজন কত হওয়া উচিত তা জানা থাকলে স্থূলতা ও কম ওজনজনিত রোগগুলোর ঝুঁকি সহজেই এড়িয়া চলা সম্ভব। বিএমআই ১৮.৫-২৩ অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীর ওজন নিচের তালিকা অনুযায়ী হওয়া যথাযথ—

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে করণীয়

অনেকেই সঠিক ওজন জানার আগেই নিজে নিজে ওজন কমানো বা বাড়ানোর চেষ্টা করেন, যা ঠিক নয়। আপনার ওজন উচ্চতা অনুযায়ী ঠিক আছে কি না, তা জানতে নির্দিষ্ট সময় পর পর ওজন পরিমাপ করুন এবং বিএমআই নির্ণয় করুন। ওজন অতিরিক্ত কম বা বেশি হলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি—

  • সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান। পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
  • অতিরিক্ত চিনি, তেল-মসলা ও চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
  • দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।

ডা. ফারজানা হক

ডা. ফারজানা হক

এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (মেডিসিন), এমএসিপি (ইউএসএ)
কনসালট্যান্ট, ইন্টারনাল মেডিসিন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিকস), কলাবাগান

LinkedIn
Share
WhatsApp