কিডনি সুস্থ রাখতে প্রয়োজন নিয়মিত রেনাল টেস্ট

কিডনি সুস্থ রাখতে প্রয়োজন নিয়মিত রেনাল টেস্ট

কিডনি আমাদের শরীরের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন করে এবং বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। শরীরের তরল ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতেও এটি সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু কোনো কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুরুর দিকে সাধারণত এর তেমন কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার পর এর উপসর্গ দেখা দেয়। এর ধারাবাহিকতায়, কিডনি অকেজো রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে ডায়ালাইসিসের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়। কোনো কারণে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিলে কয়েক দিনের মধ্যে সে রোগী মারা যায়। এমন একটি ঘাতক ব্যাধি থেকে বাঁচতে তাই রোগ প্রতিরোধ করাটাই হবে সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তাই কিডনির কার্যক্রম ঠিকঠাক চলছে কি না, তা জানতে নিয়মিত বিরতিতে রেনাল টেস্ট বা কিডনি ফাংশন টেস্ট করাতে পারেন।

রেনাল টেস্ট কেন জরুরি

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আবার বাবা-মা কিডনি রোগে ভুগে থাকলে, সন্তানের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সাধারণত শুরুতে কিডনি রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায় না, তাই এ রোগ নীরবে মৃত্যুঝুঁকির কারণ হয়। তবে নিয়মিত রেনাল টেস্ট করলে কিডনি-স্বাস্থ্যের সার্বিক ধারণা পাওয়া যায়। এতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকিও এড়ানো সম্ভব হয়। এছাড়া, যাঁরা কিডনি রোগে ভুগছেন, তাঁরা রেনাল টেস্টের মাধ্যমে চিকিৎসার অগ্রগতি এবং ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কেও জানতে পারেন। কিডনির যেকোনো সমস্যা যেমন—কিডনি ইনফেকশন, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ কিংবা কিডনিতে পাথর থাকলে, তা প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা যায় এই টেস্টের মাধ্যমে।

রেনাল টেস্টে কী কী পরীক্ষা করা হয়

সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা : রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ জানতে এই পরীক্ষা করা হয়। কিডনি দ্বারা রক্ত পরিশোধনের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু কিডনি যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে রক্তে এটির উপস্থিতি বেড়ে যায়।

ব্লাড ইউরিয়া নাইট্রোজেন পরীক্ষা : কিডনি ঠিকভাবে কাজ না করলে রক্তে ইউরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। ব্লাড ইউরিয়া পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে এর মাত্রা নির্ণয় করা হয়।

গ্লোমেরুলার ফিল্টারেশন রেট পরীক্ষা : কিডনি কতটা কার্যকরভাবে রক্ত পরিশোধন করতে পারছে, তা জানতে এই পরীক্ষা করা হয়।

ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা : সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইডসহ শরীরে খনিজ পদার্থের সমতা-অসমতা এবং মাত্রা জানতে এই পরীক্ষা করা হয়।

ইউরিনালাইসিস : কিডনির সমস্যা নির্ণয় করা যায় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। এর সঙ্গে আরো কিছু স্বাস্থ্যসমস্যা নির্ণয় করা যায়, যেমন—ডায়াবেটিস, লিভার ডিজিজ ইত্যাদি।

রেনাল টেস্টের অন্তর্ভুক্ত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা রয়েছে। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি-স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শরীর কতটা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাও জানা যায়। যেমন—বডি ম্যাস ইনডেক্স, লিপিড প্রোফাইল, ইউরিক অ্যাসিড, অ্যালবুমিন, টিএসএইচ, ইসিজি, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম ও এসজিপিটি।

কখন করবেন রেনাল টেস্ট

নিয়মিত রেনাল টেস্ট করলে কিডনির কার্যকারিতার ওপর সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তার দ্রুত চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা যায়। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়। কিডনির রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা গেলে, জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই নিয়মিত বিরতিতে রেনাল টেস্ট করা জরুরি। শরীরে নানা সময়ে কিছু অসঙ্গতি দেখা যায়, যেগুলো হতে পারে কিডনি রোগের লক্ষণ। নিম্নবর্ণিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে তাই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রেনাল টেস্ট করিয়ে নিন।

  • পায়ে পানি আসা।
  • ক্ষুধা কমে যাওয়া।
  • বমি বমি ভাব, কিংবা ঘন ঘন বমি হওয়া।
  • শারীরিক দুর্বলতা ও অবসন্নতা।
  • শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
  • প্রসাবের পরিমাণ, রং ও অভ্যাসে পরিবর্তন আসা।
  • উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্ট।

কার জন্য বেশি প্রয়োজন

ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ডায়াবেটিস বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মহামারির মতো বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবারের কেউ না কেউ ডায়াবেটিসে ভুগছে। আবার দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ জানে না যে তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, চোখ ও কিডনির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। রেনাল টেস্টের মাধ্যমে এই রোগগুলো কিডনিতে কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নির্ধারণ করা যায়। তাছাড়া পরিবারে কেউ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে বাকি সদস্যদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিডনি রোগ বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকেও আক্রান্ত করতে পারে। যাঁর কিডনি রোগ শনাক্ত হয়েছে, তিনিও রেনাল টেস্টের মাধ্যমে রোগের ধরন ও ক্ষতির পরিমাণ জানতে পারবেন। ৪০ বছরের অধিক বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের অনেক বেশি ওষুধ খেতে হয়— তাঁদের নিয়মিত বিরতিতে রেনাল টেস্ট করে কিডনির সুস্থতা যাচাই করা খুব জরুরি। এমন কিছু ওষুধ আছে, যা কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। ওষুধগুলো কিডনির ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তাও জানা যায় রেনাল টেস্টে।

ঝুঁকি এড়াতে মেনে চলুন জরুরি কিছু স্বাস্থ্যবিধি

  • ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগের ঝুঁকি থাকলে বছরে অন্তত একবার রেনাল টেস্ট করিয়ে নিন।
  • প্রস্রাবে ইনফেকশন, ক্লান্তি কিংবা শরীর ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিন।
  • ডায়রিয়া, বমি, রক্তআমাশয় ও পানিশূন্যতায় ভুগলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে, কারণ এসব থেকেও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করুন। নিয়মিত রক্তচাপ মেপে দেখুন এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন এবং ধূমপান বর্জন করুন।
  • রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক প্রভৃতি ওষুধ খাওয়া যাবে না। নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তুলুন।


ডা. ইশতিয়াক মোশাররফ

ডা. ইশতিয়াক মোশাররফ

এমবিবিএস, এমডি (নেফ্রোলজি)
বিসিএস (স্বাস্থ্য)
কিডনি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস
অ্যান্ড ইউরোলজি, ঢাকা
কনসালট্যান্ট, নেফ্রোলজি
চেম্বার : ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিক), কলাবাগান

LinkedIn
Share
WhatsApp