কোলন ক্যানসার : দ্রুত শনাক্তের অভাবে বাড়ছে মৃত্যুহার

কোলন ক্যানসার : দ্রুত শনাক্তের অভাবে বাড়ছে মৃত্যুহার

অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক

বিশ্বব্যাপী দ্রুত বেড়ে চলেছে কোলন ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা। পূর্বে মধ্যবয়সী ও বয়স্কদের মধ্যে এই ক্যানসারের প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও, বর্তমানে তরুণ ও কমবয়সীদের মধ্যেও বাড়ছে এ সংখ্যা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শুরুতে কোনো লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই নীরবে জাল বুনতে থাকে এ ক্যানসার। ফলে, জটিল পর্যায়ে গিয়ে যখন রোগ শনাক্ত হয়, ততক্ষণে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। যেকোনো রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে। নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তুললে প্রাথমিক পর্যায়েই এ রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি ক্যানসারের লক্ষণসমূহ জানা থাকলে, রোগী নিজেও সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। এতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে দ্রুত চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে, চিকিৎসায়ও ভালো ফল পাওয়া যায়।

কোলন ক্যানসার : দ্রুত শনাক্তের অভাবে বাড়ছে মৃত্যুহার

কোলন ক্যানসার কী

শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে প্রতিনিয়ত মানবদেহে সুশৃঙ্খল নিয়মে কোষের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কিন্তু কোনো কারণে এই কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কোষের বিভাজন তৈরি হয়। বিভাজিত বাড়তি কোষ থেকে ধীরে ধীরে টিউমারের উৎপত্তি হতে পারে। আর এসব টিউমারের কোনোটি ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যানসারে পরিণত হয়। পরিপাকতন্ত্রের শেষ অংশের নাম কোলন। এখানে শুরু হওয়া ক্যানসারকেই কোলন ক্যানসার বলে। কোলনের পরের অংশের নাম রেকটাম বা মলাশয়। কোলন ও মলাশয় এই দুই অংশের ক্যানসারকে একত্রে কোলোরেক্টাল ক্যানসার বলা হয়।

কোলন ক্যানসার কেন হয়

নানা কারণে কোলন ক্যানসার হতে পারে। বংশগত কারণে ক্যানসার হতে পারে। আবার অসম খাদ্যাভ্যাসের কারণেও ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এরকম কয়েকটি কারণ হলো—

  • পরিবারে কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, পরবর্তী প্রজন্ম এ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে।
  • বিনাইন টিউমার আকারে মলদ্বার বা মলাশয়ের ভেতরের দেয়ালে পলিপস থাকলে, পরবর্তীকালে তা ম্যালিগন্যান্টে পরিণত হতে পারে।
  • উচ্চ প্রাণিজ প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া এবং ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
  • অতিমাত্রায় কোষ্ঠকাঠিন্য এবং আলসারজনিত প্রদাহের কারণেও এ ক্যানসারে আক্রান্ত ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

লক্ষণ ও উপসর্গ

কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিতে পারে—

কারা আছেন ঝুঁকিতে

কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন যেকোনো বয়সের মানুষ। তবে বয়স্করা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কিছুটা বেশি। তবে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যেও বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। পরিবারে কারো কোলন ক্যানসারে আক্রান্তের ইতিহাস থাকলে, অন্যদেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মদ ও ধূমপানের অভ্যাস যাঁদের রয়েছে, তাঁরাও আছেন ঝুঁকিতে। বৃহদন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ, যেমন—ক্রোন’স ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগে ভুগলে, কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে।

রোগ নির্ণয়

কোলন ক্যানসার নির্ণয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে একটি কলোনোস্কপি। এতে কোনো ক্ষত বা টিউমার পাওয়া গেলে বায়োপসি করা হয়। বায়োপসির মাধ্যমে ক্যানসার নির্ণয়ের পর সিটি স্ক্যান, এমআরআই ও কার্সিনোএমব্রায়োনিক অ্যান্টিজেন (সিইএ) পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসারের ধাপ বা পর্যায় নির্ণয় করা হয়। সঠিক চিকিৎসা প্রদানে এই পর্যায়গুলো জানা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসা

প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকা ক্যানসারের চিকিৎসা-পরবর্তী ফলাফল বেশ সন্তোষজনক হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসারের বিস্তৃতি ও জটিলতা অনেক বেশি থাকায় চিকিৎসা কার্যক্রম ও নিরাময়ে অনেক বেগ পেতে হয়। অনেকাংশে ফলাফল আশানুরূপ হয় না। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, চিকিৎসকগণ রোগীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত করা যায়। রোগ নির্ণয়ের পর রোগীর স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও ক্যানসারের পর্যায় বিবেচনা করে চিকিৎসা কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করা হয়। সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি পদ্ধতিতে এ রোগের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। তবে সার্জারি হচ্ছে এর অন্যতম প্রধান চিকিৎসা। বাংলাদেশে ল্যাপারোস্কপিক কলোরেক্টাল সার্জারি অনেক উন্নতি লাভ করেছে। বর্তমানে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপারস্পেশালিটি সেন্টারে কলোরেক্টাল ক্যানসারের ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়

ইতিবাচক জীবনযাপন পদ্ধতি এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষা কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই প্রাত্যহিক জীবনে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। যেমন—

কোলন ক্যানসার : দ্রুত শনাক্তের অভাবে বাড়ছে মৃত্যুহার
  • ৪৫ বছরের বেশি বয়সীরা নিয়মিত ক্যানসারের পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। বিশেষ করে যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন।
  • প্রয়োজনীয় সব পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবারের সমন্বয়ে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • খাদ্যতালিকায় রাখুন ফলমূল, শাকসবজি ও গোটা শস্য। এতে থাকা ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন।
  • দিনে অন্তত ত্রিশ মিনিট করে শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন নিয়ম করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন।
  • সব বয়সীদের মধ্যেই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই সবার উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
  • কোলন ক্যানসারের লক্ষণসমূহ দেখা দিলে, সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিন।

অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক

অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এম. ফিল (রেডিওথেরাপি)
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট
রেডিয়েশন ও ক্লিনিক্যাল অনকোলজি
চেম্বার : ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপারস্পেশালিটি সেন্টার

LinkedIn
Share
WhatsApp