জন্ডিস নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা
ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার
লিভারের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়াসহ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের মতো নানা জটিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো জন্ডিস। নবজাতক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারেন। জন্ডিস নিয়ে আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। চিকিৎসকের পরামর্শে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ২-৪ সপ্তাহের মধ্যেই জন্ডিস থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
জন্ডিস নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা
জন্ডিস নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে নানা ভুল ধারণা। এখনও বেশিরভাগ মানুষই জন্ডিস হলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে কবিরাজের কাছে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কবিরাজের কাছে আক্রান্ত ব্যক্তি নানা অপচিকিৎসার শিকার হন। যেমন— হাত ধোয়ানো, মালা পরানো, বিভিন্ন রকম গাছের পাতা ও রস খাওয়ানো। এতে জন্ডিস তো ভালো হয়ই না, বরং লিভারের আরও ক্ষতি হয়। কবিরাজ দেখালে জন্ডিস সেরে যায় এমন ভাবার অন্যতম কারণ হলো— কবিরাজ হয়তো ঝাড়ফুঁকের পাশাপাশি রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেন। আর জন্ডিসের প্রধান প্রতিকারই হলো— নিজে বিশ্রাম নেওয়ার মাধ্যমে লিভারকে বিশ্রাম দেওয়া। বিশ্রামে থাকলে লিভার আপনাআপনি সুস্থ হয়ে যায়; জন্ডিসও সেরে যায়। কিন্তু মানুষ ভাবে, কবিরাজের পরামর্শে ভালো হয়ে গেছে।

আবার অনেকেই আছেন যারা জন্ডিস হলে বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে বেশি বেশি পানি, আখের রস, ডাবের পানি পান করতে হবে বলে মনে করেন। জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা তরকারি খেতে দেওয়া যাবে না, জন্ডিসে আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ শিশুকে পান করানো যাবে না, বারবার গোসল করতে হবে এমন সব ধারণাও মানুষের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এসব বিশ্বাসের আসলে কোনো যুক্তি নেই। জন্ডিসে তরলের ঘাটতি পূরণে ফলের রস, ডাবের পানি পান করা ভালো হলেও অতিরিক্ত প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া আখের রসে থাকতে পারে হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস যা জন্ডিস হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। তাই এটি বর্জন করাই ভালো। আবার, খাবারে হলুদ ব্যবহারের সঙ্গে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই জন্ডিসের রোগী হলুদ দেওয়া তরকারি খেতে পারবে না, এটি সত্য নয়। মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে জন্ডিস শিশুর মধ্যে সংক্রমিত হয় না। তবে, গর্ভবতী মায়ের যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসজনিত জন্ডিস হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা ও ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন দেওয়া জরুরি।
মনে রাখতে হবে, জন্ডিস কিন্তু কোনো রোগ নয়। বিভিন্ন রোগের উপসর্গ এটি। বারবার জন্ডিস হওয়া মারাত্মক কোনো রোগকে ইঙ্গিত করে। সুতরাং, জন্ডিস হলে কবিরাজের কাছে না গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। পাশাপাশি জন্ডিসের কারণ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন, সুস্থ থাকুন।
জন্ডিস কী
আমাদের রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে একটি হলো বিলিরুবিন। এটি হলুদ বর্ণের একটি রঞ্জক পদার্থ। রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে লিভারে বিলিরুবিন তৈরি হয়। পরে মলমূত্রের মাধ্যমে কিছু অংশ বের হয়ে যায় এবং কিছু অংশ শরীরে থাকে। আমাদের শরীরে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে বিলিরুবিনের সাধারণ মাত্রা ১-১.২ মিলিগ্রামের কম। কিন্তু কোনও কারণে যদি তা ১.৫ মিলিগ্রামের বেশি হয়ে যায়, তা হলে এটি জমা হতে থাকে শরীরের বিভিন্ন কোষ-কলায়। তখন শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন— ত্বক, চোখের সাদা অংশ ও অন্যান্য মিউকাস ঝিল্লির স্বাভাবিক রং পরিবর্তিত হয়ে হলুদাভ হয়ে যায়। এই ধরনের শারীরিক অবস্থাকে জন্ডিস বলা হয়।
কেন হয়
বিভিন্ন কারণে জন্ডিস হতে পারে। যেমন—
- ভাইরাল হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি ও ই -এর সংক্রমণে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এতে লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে লিভার থেকে বিলিরুবিন সঠিক মাত্রায় নিষ্কাশিত হতে না পেরে জন্ডিসে রূপ নেয়।
- পিত্তথলি ও পিত্তনালিতে পাথর, টিউমার ও অগ্ন্যাশয়ের কোনো রোগ হলে লিভার থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে পিত্তরস নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তে বিলিরুবিন জমে জন্ডিস দেখা দেয়।
- জন্মের পর শিশুর লিভার পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হয়। কিন্তু নবজাতকের রক্তের কণিকা দ্রুত ভাঙতে থাকে। পাশাপাশি রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রাও বাড়তে থাকে যা লিভার সমানতালে অপসারণ করতে পারে না। ফলে শিশু জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া যেমন— থ্যালাসেমিয়া, সেল অ্যানিমিয়া ও উইলসন ডিজিজের মতো কিছু বংশগত রোগের কারণে লোহিত রক্তকণিকা অস্বাভাবিক হারে নষ্ট হয়ে যায়। তখন বিলিরুবিনের মাত্রাও অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়।
- লিভারের ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জন্ডিস হতে পারে।
- অতিরিক্ত মদ্যপান ও রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকার কারণেও জন্ডিস হতে দেখা যায়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
- মৃদু বা তীব্র জ্বর।
- শারীরিক দুর্বলতা।
- পেটে ব্যথা।
- খাবারে অরুচি।
- বমিভাব বা বমি।
- চুলকানি।
- দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।

- চোখের সাদা অংশ ও ত্বকের রং হলুদ হয়ে যাওয়া।
- মুখের ভেতরের অংশের ত্বক বিশেষ করে মাড়ি ও জিভ হলুদ হয়ে যাওয়া।
- প্রস্রাবের রং হলুদ হওয়া।
- মলের রং পরিবর্তন।
জন্ডিস হলে করণীয়
জন্ডিস হলে আতঙ্কিত না হয়ে এই বিষয়গুলো মেনে চলুন—
- সুষম ও সহজপাচ্য খাবার খান।
- বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
- ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম নিশ্চিত করুন।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকুন।
- সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার তৈরি করুন।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
- হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘বি’ ভাইরাসের টিকা নিশ্চিত করুন।

ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার
ব্যবস্থাপক,
মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স
ল্যাবএইড হাসপাতাল