জরায়ুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
জরায়ু একজন নারীর শরীরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। নারীর সার্বিক সুস্থতা ও প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য জরায়ুর সঠিক যত্ন ও সচেতনতা তাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জরায়ু কেবল গর্ভধারণের বিষয় নয়, বরং নারীর হরমোন নিয়ন্ত্রণ, ঋতুচক্র এবং শারীরিক ভারসাম্য রক্ষায় এটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জরায়ুর কিছু রোগ—যেমন জরায়ুমুখের ক্যানসার, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার, জরায়ু ফাইব্রয়েড, এন্ডোমেট্রিওসিস, ওভারিয়ান সিস্ট ইত্যাদি নারীদের স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগগুলো প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা না গেলে জটিলতা অনেক বেড়ে যায়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলে দেওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। তবে সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুজনিত অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জরায়ুর রোগশোক
জরায়ুতে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে পারে, যা নারীর প্রজনন ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
জরায়ু ফাইব্রয়েড : এ সমস্যায় জরায়ুতে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি হয়। কিন্তু কোষগুলো থাকে নন-ক্যানসারাস। এটি মূলত টিউমার, যা সাধারণত তেমন ক্ষতিকর নয়। তবে এতে আক্রান্ত হলে পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হয়। যৌন মিলনে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দেয়।
এন্ডোমেট্রিওসিস : নারীর জরায়ুতে তিনটি পর্দা বা স্তর রয়েছে। সব থেকে ভেতরের স্তরকে বলা হয় এন্ডোমেট্রিয়াম। প্রতি মাসে পিরিয়ডের সময় এই এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ ছিঁড়ে রক্তপাত হয়। সাধারণত এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ শুধু জরায়ুর ভেতরেই থাকার কথা। কিন্তু জরায়ু ছাড়াও যদি এ কোষ জরায়ুর বাইরে, ডিম্বনালিতে, ডিম্বাশয়ে, অন্ত্রে, মূত্রনালিতে ও মলদ্বারে থাকে তাহলে পিরিয়ডের সময় এসব অংশের কোষ ছিঁড়েও রক্তক্ষরণ হয়। এ কারণে তলপেটে তীব্র ব্যথা ও রক্তক্ষরণের ফলে ডিম্বাশয়ে রক্ত জমে সিস্ট তৈরি হওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যার ফলে গর্ভধারণেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
অ্যাডিনোমায়োসিস : জরায়ুর চারপাশে যে পেশির স্তর রয়েছে তাতে এন্ডোমেট্রিয়াল গ্রন্থি তৈরি হলে তাকে অ্যাডিনোমায়োসিস বলা হয়। মূলত এ অবস্থায় জরায়ুর আস্তরণ জরায়ুর পেশির মধ্যে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
জরায়ুর পলিপ : জরায়ুর অভ্যন্তরে ছোট ছোট পিণ্ডের মতো টিস্যু বৃদ্ধি পায়—এগুলো মূলত জরায়ুর পলিপ। এটির আরেক নাম এন্ডোমেট্রিয়াল পলিপ। সাধারণত এগুলো নন-ক্যানসারাস হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো এই কোষগুলো ক্যানসারে পরিণত হয়। এতে আক্রান্ত হলে ঋতুচক্রের মধ্যবর্তী সময়েও যোনিপথে রক্তপাত হয়, পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় এবং মেনোপজের পরও যোনিপথে রক্ত আসে।
ওভারিয়ান সিস্ট : ডিম্বাশয়ে তরলযুক্ত থলির নাম জরায়ু সিস্ট। এসব থলির সংখ্যা হতে পারে এক বা একাধিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সিস্টের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না এবং শরীরেও খুব একটা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। এগুলো দুই-তিন মাসের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু এমন কিছু সিস্ট আছে, যা থেকে বন্ধ্যাত্ব সমস্যার মতো শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
জরায়ুর প্রদাহ (সার্ভিসাইটিস) : যোনির সঙ্গে সংযুক্ত জরায়ুর নিচের অংশটিকে বলা হয় সার্ভিক্স। সার্ভিক্সে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস কিংবা গনোরিয়ার মতো যৌনবাহিত রোগের সংক্রমণের ফলে প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। আর সার্ভিক্সে প্রদাহজনিত অবস্থাকে বলা হয় সার্ভিসাইটিস।
জরায়ু ক্যানসার : জরায়ুতে সাধারণত দুই ধরনের ক্যানসার বেশি দেখা যায়। এর একটির নাম সার্ভিকাল ক্যানসার বা জরায়ুমুখের ক্যানসার। অপরটি অ্যান্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে ওভারিয়ান সিস্ট থেকেও ক্যানসার দেখা দিতে পারে।
জরায়ুমুখের ক্যানসার : যেকোনো বয়সী নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে ৩০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। হিউম্যান প্যাপিলোমা নামক ভাইরাস দ্বারা সার্ভিক্স আক্রান্ত হলে অতিরিক্ত কোষের জন্ম হয়। যা পরবর্তীকালে ক্যানসারে পরিণত হতে পারে। পেপ টেস্ট ও এইচপিভি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা যায়।
এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার : জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণে এই ক্যানসার হয়। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়েই এ ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। এ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে এর লক্ষণ হিসেবে যোনিপথে অনিয়মিত রক্তপাত হয়। এমন লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত নারী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে খুব সহজেই রোগ শনাক্ত করে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
যেসব লক্ষণ-উপসর্গ এড়িয়ে গেলে বাড়তে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি
জরায়ুর রোগব্যাধির কোনোটি খুব দ্রুত লক্ষণ প্রকাশ করে। আবার কোনোটি জটিলতা বাড়িয়ে তোলার পর রোগের জানান দেয়। তবু মোটাদাগে জরায়ুর রোগব্যাধির কিছু বিষয় রয়েছে যা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে দ্রুত রোগ শনাক্ত করা যায়। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেকাংশে হ্রাস পায়। এমন কিছু লক্ষণ-উপসর্গ হলো—

- অনিয়মিত পিরিয়ড এবং পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
- যোনিপথে অস্বাভাবিক রক্তপাত।
- মেনোপজ-পরবর্তী সময়েও রক্তপাত।
- যোনি থেকে সাদা বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব আসা।
- তলপেটে ব্যথা ও প্রচণ্ড চাপ অনুভব করা।
- যৌন মিলনের সময় তীব্র ব্যথা অনুভব করা।
- অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া এবং সারাক্ষণ ক্লান্তি বোধ করা।
- গর্ভধারণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা।
জরায়ুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জরুরি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা
পেপ টেস্ট : এ পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু ক্যানসার, ক্যানসারের পূর্বাবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ যেমন—ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ শনাক্ত করা যায়। এতে কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না। জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রকাশ পেতে ১২ থেকে ১৫ বছরও সময় লেগে যেতে পারে। তাই বয়স ২১ বছর থেকে ৬৪ বছর পর্যন্ত বা বিয়ের পর প্রতি তিন বছর অন্তর পেপ টেস্ট করা উচিত।
এইচপিভি টেস্ট : জরায়ু ক্যানসারের প্রধান কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ। প্রায় ১০০ প্রজাতির প্যাপিলোমা ভাইরাস রয়েছে, এর মধ্যে জরায়ু ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি নম্বর ১৬, ১৮, ৩১, ৩৩ ও ৩৫। এইচপিভি টেস্টের মাধ্যমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ নির্ণয় করা যায়।
পেলভিক আলট্রাসাউন্ড : জরায়ুর ফাইব্রয়েড, ডিম্বাশয়ের সিস্ট, টিউমার এবং অন্যান্য গঠনতান্ত্রিক সমস্যা চিহ্নিত করতে এই পরীক্ষা খুব কার্যকর পদ্ধতি।
কলপোস্কপি : পেপ টেস্টে জরায়ুর কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত হলে কলপোস্কপির মাধ্যমে তা আরো নিখুঁতভাবে দেখা হয়। এ পদ্ধতিতে যন্ত্রের সাহায্যে জরায়ুমুখ ২ থেকে ২৫ গুণ বড় করে জরায়ুর কোষ পরীক্ষা করা হয়।
এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি : এ পদ্ধতিতে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণ থেকে কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তপাত এবং মেনোপজের পরও রক্তক্ষরণের কারণ যাচাই করতে এটি খুব কার্যকর পদ্ধতি।

ডা. সেরাজুম মুনিরা
এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস (গাইনি অ্যান্ড অবস্)
এমসিপিএস (গাইনি অ্যান্ড অবস্)
এফসিপিএস (রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি)
ট্রেনিং ইনফার্টিলিটি (ভারত)
প্রসূতি, স্ত্রীরোগ, ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন
প্রাক্তন কনসালট্যান্ট, রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি
ও ইনফার্টিলিটি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্রাক্তন কনসালট্যান্ট,
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল