জেনে নিন লিভারের খবর
লিভারের অধিকাংশ রোগ সাধারণত নীরব ঘাতক। কোনো প্রতিক্রিয়ার জানান না দিয়ে, নীরবেই ক্ষতি করে যায়। শুরুতে এসব রোগ তেমন কোনো লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ করে না। কিন্তু শরীরে যখন এর প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তত দিনে রোগ থাকে জটিল পর্যায়ে। স্বাস্থ্যযত্ন ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রতি উদাসীনতা লিভারের রোগ সংক্রমণ ও রোগের জটিলতা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী। তবে, প্রাথমিক পর্যায়ে লিভারের রোগ শনাক্ত হলে জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

লিভারে বাসা বাঁধে নানা রোগ
হেপাটাইটিস : হেপাটাইটিস ভাইরাসজনিত রোগ, যা লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই—এই ৫ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণে লিভারে প্রদাহ হয়। হেপাটাইটিস ভাইরাসের কোনোটি স্বল্পমেয়াদি প্রদাহের সৃষ্টি করে, যেমন—হেপাটাইটিস এ এবং ই। দূষিত খাবার ও পানিসহ নানা কারণে হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে।
আবার কোনোটি দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণ হয়। যেমন—হেপাটাইটিস বি এবং সি। দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালন, অপারেশন ও রক্তপাতের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ভাইরাস দুটির দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণে লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার হতে পারে।
জন্ডিস, জ্বর, বমি বমি ভাব, অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করা এবং খাবারে অরুচি হেপাটাইটিসের অন্যতম লক্ষণ। বংশপরম্পরায় মানুষ এ রোগের বাহক হতে পারে।
ফ্যাটি লিভার : লিভারে চর্বির উপস্থিতিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। লিভার খাবার হজমে সহযোগিতা করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এতে চর্বি জমতে থাকলে ধীরে ধীরে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি জমার পাশাপাশি লিভারে প্রদাহ শুরু হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় নন–অ্যালকোহলিক স্ট্যায়াটোহেপাটাইটিস বা ন্যাশ। সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে, এক পর্যায়ে ফাইব্রোসিস, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার দেখা দিতে পারে। জীবনযাত্রার অনিয়মের ফলেই এ রোগ বেশি দেখা দেয়। পেট ফাঁপা, ক্লান্তি, পেটের ওপরের ডান দিকে ব্যথা ও অস্বস্তিভাব ফ্যাটি লিভারের অন্যতম কয়েকটি লক্ষণ।
লিভার সিরোসিস : লিভারের প্রদাহজনিত কারণে লিভারের কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এতে লিভারের স্বাভাবিক গঠন বা আকৃতি পরিবর্তন হয়। লিভারে তৈরি হয় সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিস। ধীরে ধীরে এটি বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে লিভার সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। লিভারের এমন অবস্থাকে বলা হয় সিরোসিস।
লিভার ক্যানসার : বিশ্বজুড়ে লিভার ক্যানসারে আক্রান্তের অন্যতম প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শুরুতে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। প্রদাহের ফলে ধীরে ধীরে লিভারে সিরোসিস বা ক্ষত দেখা দেয়। আর লিভারের ক্ষত কোষগুলো সুস্থ কোষের ডিএনএর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে ও পরিবর্তন ঘটায়। যার ফলে লিভারে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে।
হেমোক্রোমাটোসিস, উইলসন ডিজিজ : মানবশরীরে কপারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে যকৃৎ এবং মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে একটি রোগ। নাম তার—উইলসন ডিজিজ। এটি একটি জিনগত রোগ।
জিনগত আরো একটি রোগ হলো হেমোক্রোমাটোসিস। এটি এমন অবস্থা, যেখানে খাদ্য থেকে প্রাপ্ত আয়রন অতিরিক্ত পরিমাণে শরীর সঞ্চয় করে রাখে। যার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লিভারের রোগ শনাক্তকরণে আধুনিক পদ্ধতি
লিভারের সুস্থতা, অসুস্থতা কিংবা প্রকৃত অবস্থা যাচাই করতে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—ফাংশনাল এবং স্ট্রাকচারাল। ফাংশন টেস্টের মাধ্যমে লিভারের কার্যক্ষমতা এবং কার্যপরিধি জানা যায়। স্ট্রাকচারাল টেস্টে দেখা হয় লিভারের আকার ও গঠনগত পরিবর্তন। কয়েকটি বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের রোগগুলো শনাক্ত করা যায়। তা হলো—
লিভার ফাংশন টেস্ট : লিভারের কার্যক্ষমতা যাচাই করতে সিরাম বিলিরুবিন টেস্ট, এসজিপিটি, এসজিওটি, অ্যালক্যালাইন ফসফেটাস ও গামা-গ্লুটামিল ট্রান্সপেপ্টিডেস পরীক্ষাগুলো করা হয়। সাধারণত লিভারের প্রদাহজনিত সমস্যায় শরীরে এসজিপিটি ও এসজিওটি বেড়ে যায়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যদি লিভারের প্রদাহজনিত সমস্যা হয় তাহলে গামা-গ্লুটামিল ট্রান্সপেপ্টিডেস বেড়ে যেতে পারে। অ্যালকালাইন ফসফেট বেড়ে যায় যদি পিত্তনালির প্রবাহপথে কোনো কারণে বাধার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ বিলিয়ারি অবস্ট্রাকশন তৈরি হলে শরীরে অ্যালকালাইন ফসফেটেজের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
এর সঙ্গে, লিভারের সিনথেটিক ফাংশন অর্থাৎ লিভার কতটুকু উৎপাদনক্ষম রয়েছে, তা জানতে সিরাম অ্যালবুমিন পরীক্ষা করা হয়।
প্রদাহজনিত রোগ হেপাটাইটিস শনাক্তকরণে কিছু পরীক্ষা
কী কারণে লিভারের কার্যকক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তা জানা যায় প্রদাহজনিত রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে। সাধারণত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে লিভারের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। হেপাটাইটিস শনাক্তকরণে কিছু সহজ পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে হেপাটাইটিসের ধরনও জানা যায়। পরীক্ষাগুলো হলো—হেপাটাইটিস এ ভাইরাস নির্ণয়ে অ্যান্টি এইচএভি আইজিএম, হেপাটাইটিস ই ভাইরাস নির্ণয়ে অ্যান্টি এইচইভি আইজিএম, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্ণয়ে এইচবিএসএজি এবং অ্যান্টি এইচবিসি টোটাল, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নির্ণয়ে অ্যান্টি এইচসিভি। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস শনাক্ত করার পর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করলে তাতে উপকার পাওয়া যায়।
আলট্রাসনোগ্রাফি : এটি লিভারের গঠন ও আকৃতিগত যেকোনো পরিবর্তন এবং রোগ শনাক্তকরণে সহজলভ্য ও কার্যকর একটি পদ্ধতি। ফ্যাটি লিভার কিংবা কোনো ভাইরাসের প্রদাহজনিত কারণে লিভারের আকৃতি বেড়ে যেতে পারে। আবার সিরোসিসে আক্রান্ত হলে লিভার ছোট হয়ে যায়। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমের লিভারের এমন আকৃতিগত পরিবর্তন সহজে শনাক্ত করা যায়।

লিভারের ভেতরে যে পিত্তনালিগুলো রয়েছে, তার প্রবাহপথে কোনো বাঁধা তৈরি হচ্ছে কি না, সেটিও আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে জানা যায়।
সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই : আলট্রাসনোগ্রাফিতে লিভারের কোনো ত্রুটি শনাক্ত হলে সিটি স্ক্যান ও এমআরআই পদ্ধতিতে আরো ভালোভাবে তা খুঁটিয়ে দেখা যায়। এ পদ্ধতিতে লিভারের কোষের পরিবর্তন, ফাইব্রোসিস, সিরোসিস ও লিভারের ক্যানসার নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়।
ফাইব্রোস্ক্যান : লিভারের অবস্থা জানার জন্য যেকোনো সুস্থ মানুষ নিয়মিত বিরতিতে ফাইব্রোস্ক্যান পরীক্ষা করতে পারেন। চিকিৎসকের পরামর্শে ফাইব্রোস্ক্যান পরীক্ষা করলে যেসব রোগ নির্ণয় করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে—অ্যালকোহলিক ও নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার, ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস, হেমোক্রোমাটোসিস ও উইলসন ডিজিজ ইত্যাদি। অত্যাধুনিক এ পদ্ধতিতে মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই লিভারের জটিল রোগসমূহ নির্ণয় করা যায়। লিভার সিরোসিসের ক্ষেত্রে সুনিপুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোষের প্রকৃত অবস্থা জানা যায় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। লিভারের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করার পর, ফলোআপের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিতে পরিবর্তিত অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।

অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ
এমবিবিএস (ডিএমসি), এমডি (হেপাটোলজি)
এফআরসিপি (লন্ডন)
লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, লিভার বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড হাসপাতাল, ধানমন্ডি