নিয়মিত করাতে পারেন যেসব স্বাস্থ্যপরীক্ষা

নিয়মিত করাতে পারেন যেসব স্বাস্থ্যপরীক্ষা

আমাদের বয়স যত বৃদ্ধি পায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তত কমতে থাকে। ফলে নানা ধরনের রোগব্যাধিতে শরীর সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সঠিক সময়ে শনাক্তকরণের অভাবে অনেক সাধারণ রোগও জটিল আকার ধারণ করতে পারে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠে। সময়মতো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব রোগের ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব।

নিয়মিত যেসব স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো আবশ্যক

বিএমআই : অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম না করা, হরমোনজনিত সমস্যা প্রভৃতি কারণে ওজন আস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে দেহ স্থূলকায় হয়ে পড়ে। ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোকসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে গেলেও বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখা। এজন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর ওজন পরিমাপ ও বিএমআই (বডি ম্যাস ইনডেক্স) নির্ণয় করা প্রয়োজন।

লিপিড প্রোফাইল : লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাসহ অন্যান্য চর্বিজাতীয় উপাদান যেমন—এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইডস ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। নিয়মিত লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হৃদরোগসহ অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

রক্তচাপ পরীক্ষা : ১৪০/৯০ মিলিমিটার পারদ বা এর বেশি রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে যেকোনো বয়সেই। তবে বয়স চল্লিশের পর এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, চোখের সমস্যা, কিডনির সমস্যাসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ কারণে বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরীক্ষা করা জরুরি।

ডায়াবেটিস পরীক্ষা : অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যার কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই ৪৫ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর অন্তত একবার ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং বা এইচবিএওয়ানসি পরীক্ষা করা জরুরি। আর যাঁদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের অবশ্যই নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা : থাইরয়েড সমস্যার কারণে শরীরের স্বাভাবিক বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে ওজন অতিরিক্ত কমে বা বেড়ে যায়, ক্লান্তি ও অবসাদ দেখা দেয়, হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে এবং শরীরে দীর্ঘমেয়াদি হরমোন ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। রক্তের টিএসএইচ (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এসব জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

দাঁত পরীক্ষা : নিয়মিত দাঁতের যত্ন না নেওয়া, চুন-জর্দা দিয়ে পান খাওয়া, বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রভৃতি কারণে দাঁতে সমস্যা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় দাঁত পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ওরাল ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া বয়স বাড়লে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে বাড়তে থাকে দাঁত ও মুখের জটিলতা। খাবার চিবোতে সমস্যা হয়। মাড়ির প্রদাহ বা পেরিওডোন্টাইটিসের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই দাঁতের সুরক্ষা বজায় রাখতে বছরে অন্তত দুবার ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো জরুরি।

ত্বক পরীক্ষা : সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব, ত্বকে মোলের উপস্থিতি, ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ যেমন— কয়লা, টার এবং আর্সেনিকের সংস্পর্শ, ত্বকের ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এজন্য নিরাপদ থাকতে প্রতিবছর অন্তত একবার ত্বক পরীক্ষা করানো উচিত।

শ্রবণ পরীক্ষা : বয়স বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা কিংবা সংক্রমণের কারণে শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। তাই শ্রবণশক্তির বর্তমান অবস্থা জানতে এবং ভবিষ্যতে শ্রবণের সমস্যা থেকে সুরক্ষিত থাকতে প্রতি দুই-তিন বছর পর পর অডিওগ্রাম পরীক্ষা করা জরুরি।


চোখ পরীক্ষা : সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পরই মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। পড়তে শুরু করে চোখে ছানি। এজন্য যাঁদের মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে কিংবা নিয়মিত চশমা ব্যবহার করেন, তাঁদের প্রতিবছর একবার এবং যাঁরা চশমা ব্যবহার করেন না তাঁদের প্রতি দুই বছর অন্তর চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।

হাড়ের পরীক্ষা : বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগ দেখা দিতে শুরু করে। এতে হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। যদিও গবেষণামতে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তবুও ৬৫ বছর বয়সের পর নারী-পুরুষ উভয়েরই নিয়মিত হাড়ের পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।

ক্যানসার পরীক্ষা : বিশ্বব্যাপী মানবমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ক্যানসার। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা না গেলে ক্যানসারে মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে যায়। তাই ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এটি শনাক্তকরণের জন্য নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো অত্যন্ত জরুরি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্যানসার পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে—

  • কোলোনস্কোপি : কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি নির্ণয়ে ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে অন্তত একবার কোলোনস্কোপি করা প্রয়োজন। তবে যদি কোলনে কোনো প্রকার পলিপ দেখা যায়, ভবিষ্যতে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ বোঝা যায় কিংবা পরিবারে কারো কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিন পর পরই কোলোনস্কোপি করানো উচিত।
  • প্রোস্টেট-স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন পরীক্ষা : রক্তে প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেনের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে প্রোস্টেটের অবস্থা জানা যায় এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা নির্ণয় করা যায়। সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর এই পরীক্ষাটি করা জরুরি। তবে পরিবারে কারো প্রোস্টেট ক্যানসার হয়ে থাকলে ৪০ বছর বয়সের পরই এটি করা উচিত।
  • ম্যামোগ্রাম : নারীদের স্তন ক্যানসার শনাক্তে কিংবা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি নির্ণয়ে ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সের মধ্যে অন্তত একবার এবং এরপর প্রতি দুই বছরে একবার ম্যামোগ্রাম করা যেতে পারে।
  • প্যাপ স্মেয়ার : প্যাপ স্মেয়ার ও পেলভিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু ক্যানসার ও শ্রোণিসংক্রান্ত জটিলতা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। ২১-৬৫ বছর বয়সী নারীদের প্রতি ৩ বছর অন্তর প্যাপ স্মেয়ার করানো উচিত। ৬৫ বছরের পর অধিকাংশ নারীরই নিয়মিত প্যাপ স্মেয়ার ও পেলভিক পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।

ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার

ডা. সিদ্ধার্থ দেব মজুমদার

ব্যবস্থাপক,
মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স
ল্যাবএইড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp