পিত্তথলিতে পাথর : চিকিৎসা কী

পিত্তথলিতে পাথর : চিকিৎসা কী

ডা. মো. সায়েফউল্লাহ

সর্ব সময়ে অতিপরিচিত একটি রোগ— পিত্তথলিতে পাথর। গলব্লাডার বা পিত্তথলি আমাদের দেহে লিভারের নিচে অবস্থিত থলের মতো একটি অঙ্গ। লিভার থেকে উৎপন্ন পিত্তরস পিত্তথলিতে সঞ্চিত থাকে। আমরা যখন খাবার খাই, বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাবার তখন পিত্তথলি থেকে পিত্তরস নির্গত হয়ে খাবার হজমে সাহায্য করে। পিত্তরসে সাধারণত পানি, বিলিরুবিন, কোলেস্টেরল, পিত্ত অ্যাসিড ও পিত্ত লবণসহ নানা পদার্থ থাকে। পিত্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বা বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে এসব পদার্থ জমাট বেঁধে পিত্তথলিতে পিত্তরস জমা হয়ে ছোট-বড় নানা আকৃতির পাথর সৃষ্টি হয়।

যাদের ঝুঁকি বেশি

নারী-পুরুষ উভয়েরই যেকোনো বয়সে পিত্তথলিতে পাথর হতে পারে। তবে ৪০ বছর বয়সের পরে এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা পিত্তথলির পাথরের সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। পাশাপাশি অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ও ভেজাল খাবার এ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। পিত্তপাথরের পারিবারিক ইতিহাস, ডায়াবেটিস, দ্রুত ওজন হ্রাস, লিভারের রোগ ও দীর্ঘদিন জন্মনিরোধক ওষুধ সেবনের কারণেও পিত্তথলিতে পাথর হতে পারে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

পিত্তথলিতে পাথর হলে এতে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং পেটের ডান দিকে বিভিন্ন মাত্রার ব্যথা অনুভূত হয়। একে কোলেসিস্টাইটিস বলে। ধীরে ধীরে পিঠে, ডান কাঁধে ও বুকেও ব্যথা শুরু হয়। এই ব্যথা দ্রুত কমে যেতে পারে আবার দীর্ঘক্ষণ স্থায়ীও হতে পারে।

এছাড়া অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার খেলেও পেটে তীব্র যন্ত্রণা হয়। সেই সঙ্গে বমিভাব বা বমি ও হালকা জ্বর হতে পারে। অনেক সময় পিত্তথলি থেকে পাথর বের হয়ে পিত্তনালিতে আটকে যায়। তখন বিলিরুবিনের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে জন্ডিস দেখা দেয়।

রোগ নির্ণয়

পিত্তথলিতে পাথর হলে যেসব উপসর্গ দেখা দেয় সেগুলোর সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক, আলসার ও অগ্ন্যাশয়ের সংক্রমণের সাদৃশ্য রয়েছে। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। সাধারণত পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর নির্ণয় করা হয়। কতগুলো পাথর রয়েছে, পাথরের আকৃতি, ধরন সবই আলট্রাসনোগ্রাফিতে শনাক্ত করা সম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করার প্রয়োজন হতে পারে অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

চিকিৎসাপদ্ধতি

পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ পাথর যখন খুব ছোট থাকে তখন তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। পাথর যখন একটু বড় হয়ে পিত্তনালিতে আটকে প্রদাহের সৃষ্টি করে তখন ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো তীব্র হতে থাকে। ততদিনে আর ওষুধের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব হয় না। ফলে একমাত্র চিকিৎসা হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাথরসহ পিত্তথলি অপসারণ। এক্ষেত্রে দুইভাবে অস্ত্রোপচার করা যায়।

  • সরাসরি পেট কেটে।
  • ল্যাপারোস্কপিক কলিসিসটেকটমি পদ্ধতিতে।

তবে এখন আর পেট কেটে অস্ত্রোপচার করার তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে কারও যদি পিত্তথলি ও পিত্তনালিতে অনেকগুলো পাথর হয়ে থাকে কিংবা অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা থাকে, সে ক্ষেত্রে পেট কেটে অস্ত্রোপচার করা লাগতে পারে।

ল্যাপারোস্কপিক কলিসিসটেকটমি পদ্ধতিতে পিত্তথলির পাথর অপসারণ

বর্তমানে পিত্তথলির পাথরসহ টিউমার, হার্নিয়া প্রভৃতি রোগের অস্ত্রোপচারে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি ল্যাপারোস্কপি। এ পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারের কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা আগে থেকে রোগীকে কোনো প্রকার খাবার বা পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হয়। ল্যাপারোস্কপিক কলিসিসটেকটমির প্রক্রিয়া হিসেবে রোগীর পেটে ৪টি ছিদ্র করে ছিদ্র পথে ভিডিও ক্যামেরাসহ একটি টিউব ও বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি প্রবেশ করানো হয়। তারপর মনিটর বা পর্দায় ভেতরের ছবি পর্যবেক্ষণ করে যেকোনো একটি ছিদ্র দিয়ে পাথরসহ পিত্তথলি বের করে আনা হয়। অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মাত্র ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে।

ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতিতে পিত্তপাথর অপসারণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সকালে অস্ত্রোপচার করা হলে রোগী চাইলে বিকালেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এছাড়া, অস্ত্রোপচারের ৩-৪ ঘণ্টা পর থেকেই তরল খাবার ও ৬ ঘণ্টা পর থেকে সব রকম খাবার খাওয়া যায়। কয়েক দিন পর থেকেই রোগী স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করতে পারবেন। এ পদ্ধতিতে পেট কাটতে হয় না বলে অস্ত্রোপচারের পর পেটে খুব সামান্যই ব্যথা অনুভূত হয়। অনেকের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে যে, ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করলে পুনরায় পাথর হতে পারে কিংবা ভুলবশত পাথর ভেতরে থেকে যেতে পারে। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। যেহেতু পাথরসহ পুরো পিত্তথলিটাই বের করে নিয়ে আসা হয়, সেহেতু পিত্তথলিতে আবার পাথর হওয়ার বা পাথর থেকে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই অভিজ্ঞ সার্জন বা শল্য চিকিৎসকের দ্বারা অস্ত্রোপচার করা জরুরি।


ডা. মো. সায়েফউল্লাহ

ডা. মো. সায়েফউল্লাহ
এফসিপিএস (সার্জারি)
সহযোগী অধ্যাপক,
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল
জেনারেল, ল্যাপারোস্কোপিক, কলোরেক্টাল ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সার্জন
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp