পেপটিক আলসার প্রতিরোধে স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব

পেপটিক আলসার প্রতিরোধে স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব

জনসাধারণের কাছে আলসার অতিপরিচিত একটি রোগ। যেকোনো বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এতে আক্রান্ত হলে দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি জেঁকে ধরে। পেটে ব্যথা, বুক জ্বালাপোড়া হয়ে যায় নিত্যসঙ্গী। আবার আলসার দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাবিহীন থাকলে জটিলতা বেড়ে যায়। রক্তবমি, রক্ত পায়খানা এমনকি ক্যানসারও হতে পারে আলসারের কারণে। তবে, আশার কথা হলো এটি নিরাময়যোগ্য অসুখ। তাছাড়া, যে ব্যাকটেরিয়া আলসার সৃষ্টি করে তা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই শনাক্ত করা যায়। এর ফলে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার আগেই ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ভালো থাকা যায়।

পেপটিক আলসার কী

আলসার অর্থ ঘা বা ক্ষত। আলসারে আক্রান্ত হলে পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আমাদের পাকস্থলীতে প্রতিনিয়ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। এটি আমাদের খাবার হজমে সহায়তা করে। স্বাভাবিক মাত্রার উৎপাদিত অ্যাসিড এবং পাকস্থলীর আস্তরণের মাঝে মিউকাস মেমব্রেন নামক একধরনের স্তর বা প্রলেপ থাকায় সরাসরি পাকস্থলীর আস্তরণের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু কোনো কারণে পাকস্থলীতে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে তখন মিউকাস মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্তের আস্তরণের সংস্পর্শে আসে এবং ক্ষত সৃষ্টি করে। পরিপাকতন্ত্রের এমন ক্ষতজনিত অবস্থাকে আলসার বলা হয়।

পেপটিক আলসার কেন হয়

প্রধানত হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এই ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের পর এটি পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্তের মিউকাস মেমব্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। যার ফলে, অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্তের আস্তরণের সংস্পর্শে আসে এবং ক্ষত সৃষ্টি করে। আবার, নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা এনএসএআইডিএস-জাতীয় ওষুধ যেমন—আইবুপ্রফেন, ন্যাপ্রক্সেন ও অ্যাসপিরিন দীর্ঘদিন সেবন করার কারণেও আলসার হতে পারে। এ ছাড়া, জন্মগতভাবে পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত কাঠামো দুর্বল হওয়া, মদ্যপান, ধূমপান, নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা এবং অধিক মসলা ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খেলে আলসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পেপটিক আলসারের ধরন

আক্রান্তের স্থান বিবেচনায় আলসার দুই ধরনের হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ডিওডেনাল আলসার। পাকস্থলীতে ক্ষত সৃষ্টি হলে তাকে পাকস্থলীর আলসার বলে। এটি গ্যাস্ট্রিক আলসার নামেও পরিচিত। আর ক্ষুদ্রান্তে আলসার হলে তাকে বলা হয় ক্ষুদ্রান্তের আলসার বা ডিওডেনাল আলসার। এই দুটি আলসার একত্রে পেপটিক আলসার নামে পরিচিত।

উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা নয়

আলসারে আক্রান্ত হলে শরীরে বেশ কিছু লক্ষণ উপসর্গ দেখা দেয়। এসব জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এতে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে আলসার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। আলসারের লক্ষণ-উপসর্গ হলো—

  • পেটের উপরিভাগে ব্যথা হয়। পেট জ্বালাপোড়া করে এবং পেট ফুলে থাকে।
  • ক্ষুধা পেলে পেটে ব্যথা হয়।
  • খাবার গ্রহণের সময়, খাওয়ার পরে এবং রাতের বেলায় পেটব্যথার মাত্রা বাড়ে।
  • বুকে ব্যথা ও জ্বালা করে।
  • কখনো বমির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে।
  • অতিরিক্ত ঢেকুর ওঠে এবং খাবার গিলতে সমস্যা হয়।
  • মলের সঙ্গে রক্তপাত হয় এবং মলের রং খয়েরি অথবা কালো রং ধারণ করে।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম দেখা দেয়। ওজন দ্রুত হ্রাস পায়।

নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে

  • আলসারের প্রধান কারণ এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষায় শরীরে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নির্ণয় হলে, ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার আগেই ওষুধের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যায়।
  • নির্দিষ্ট কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় অনেকের নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হয়। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের ওষুধ সেবন আলসারের কারণ হতে পারে। তারা নিয়মিত আলসার স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব জেনে নিতে পারেন। এতে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা হলে চিকিৎসা কার্যক্রম সহজ হবে এবং রোগ নিরাময়ও দ্রুত হবে।
  • এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার ও পানীয়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং ক্ষত সৃষ্টি করে। রাস্তার পাশের খোলা খাবার, মদ্যপান, ধূমপান, অধিক মশলাযুক্ত খাবার গ্রহণ, নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আলসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাই যাঁরা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পেটব্যথা কিংবা বুক জ্বালাপোড়া দেখা দিলে সাধারণ সমস্যা ভেবে অবহেলা করা ঠিক না। দীর্ঘদিনের অনির্ণীত আলসার গ্যাস্ট্রিক ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই এসব ঝুঁকি এড়াতে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।

স্ক্রিনিং কীভাবে করা হয়

এন্ডোস্কোপি : আলসার নির্ণয়ে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে এন্ডোস্কোপি। এ পদ্ধতিতে একটি নলের সাহায্যে পাকস্থলীতে ক্যামেরা প্রবেশ করানো হয় এবং সরাসরি আক্রান্ত স্থানের ছবি তোলা হয়। এর মাধ্যমে কোথায়, কোন অংশে কতটুকু জায়গাজুড়ে আলসার হয়েছে তা নিপুণভাবে জানা যায়।

ইউরিয়া শ্বাস পরীক্ষা : শরীরে এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নির্ণয়ে অত্যন্ত কার্যকর এই পদ্ধতি। ইউরিয়া শ্বাস পরীক্ষা খুবই সহজ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা যায়। নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে একটি বিশেষ ব্যাগ বা থলেতে রোগীর শ্বাস নিয়ে তা পরীক্ষা হয়।

রক্ত ও মলের পরীক্ষা : রক্তের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা (অ্যান্টি এইচ পাইলোরি আইজি) ও স্টুল অ্যান্টিজেন পরী ক্ষার মাধ্যমে এ রোগ শনাক্ত করা যায়।


অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার সরকার

অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার সরকার

এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ)
বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (গ্যাস্ট্রো) বিএসএমএমইউ
অধ্যাপক (গ্যাস্ট্রো)
মেডিসিন, লিভার ও পরিপাকতন্ত্র রোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp