ফ্যাটি লিভার : লিভারে নীরবে বাসা বাঁধে যে রোগ

ফ্যাটি লিভার : লিভারে নীরবে বাসা বাঁধে যে রোগ

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল

ফ্যাটি লিভার কী

ফ্যাটি লিভার বলতে সাধারণত লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমাকে বোঝানো হয়। ফ্যাটি লিভার রোগটার নাম মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই রোগটির কারণ বলা রয়েছে। লিভারে সাধারণ নিয়মেই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় চর্বি জমা থাকে। শরীর যখন কোনো ঝামেলায় পড়ে, শরীরের যখন অতিরিক্ত শক্তির দরকার হয়, লিভার তখন সেই জমানো চর্বি থেকেই শক্তি সরবরাহ করে। লিভারের মোট ওজনের পাঁচ ভাগ পর্যন্ত চর্বি জমা থাকতেই পারে। একে আমরা ফ্যাটি লিভার বলি না। এটা যখন বেড়ে যায়, স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন আমরা তাকে ফ্যাটি লিভার বলি।

ফ্যাটি লিভার হলে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে

২০০৬-০৭ সালেও লিভার বিশেষজ্ঞরা ফ্যাটি লিভার সম্বন্ধে অল্পই জানতেন, কারণ এ বিষয়ে খুব কমই লেখা থাকত সে সময়কার লিভারের পাঠ্য বইগুলোয়। কিন্তু এখন যেকোনো টেক্সট বই, এমনকি মেডিসিনের বইয়েও ফ্যাটি লিভারের ওপর আলাদা অধ্যায় থাকে। এই রোগ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো অনেকটাই সাম্প্রতিক। আমরা ক্রমেই বেশি করে জানতে পারছি, আসলে ফ্যাটি লিভার কী। আগে মনে করা হতো, হার্টে বা মস্তিষ্কে চর্বি জমলে ঝামেলা, লিভারে জমলে ঝামেলা নেই। কিন্তু এখন আমরা জানি, যাদের লিভারে চর্বি জমে, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভবিষ্যতে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারেও আক্রান্ত হতে পারেন। একই কথা হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, অর্থাৎ আক্রান্ত সবার না হলেও, কারো কারো লিভারে খারাপ রোগ দেখা দেবে। এখন কথা হলো, কাদের সমস্যা দেখা দেবে আর কাদের দেখা দেবে না? এসব নিয়েও আমাদের ধারণা ক্রমশই পরিবর্তন হচ্ছে।

আমরা সাধারণত জানি, লিভারে যাদের চর্বি জমে, তাদের কারো কারো ফ্যাটি লিভার থাকে আর কারো কারো থাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস। যেমন ধরুন, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ক্যারিয়ার ও সক্রিয় পর্যায়।

ফ্যাটি লিভার থেকে লিভারে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস থাকলে আমরা বলি ন্যাশ, অর্থাৎ নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়োটোহেপাটাইটিস। যাদের ন্যাশ থাকে তাদের লিভার সিরোসিস এমনকি লিভারে ক্যানসার হওয়ারও ঝুঁকি থেকে যায়। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, কাদের ঝুঁকি রয়েছে, কাদের ঝুঁকি নেই। আগে আমরা জানতাম, শরীরে কিছু কিছু মেটাবলিজমের অস্বাভাবিকতার কারণে এমনটি হয়। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক প্র্যাকটিসে দেখি, কিছু কিছু মানুষ আসে লিভারে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ চর্বি নিয়ে, তবে তাদের লিভার খুব ভালো। আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাদের লিভারে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ চর্বি, তারপরও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে, লিভার সিরোসিস হয়ে গেছে। এখন আমরা আস্তে আস্তে জানতে পারছি যে ফ্যাটি লিভারের একটি জিনগত কারণও রয়েছে। জিনগত কারণে কারো কারো শুরু থেকেই ন্যাশ থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে ন্যাশটা খুব বেশি বেড়ে যায়। তার মানে, এখানে দুটো কারণ রয়েছে, একটি হলো পরিবেশগত কারণ আর অন্যটি হলো, খাওয়া-দাওয়া আর কিছু কিছু রোগ যার কারণে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে। শরীরের কিছু কিছু মেটাবলিজমজনিত অস্বাভাবিকতার কারণে ফ্যাটি লিভার খারাপের দিকে যাবে। পাশাপাশি জিনগত বিষয়ও রয়েছে।

ফ্যাটি লিভারের সাথে অন্য কোনো রোগের যোগাযোগ আছে কিনা

এমন কিছু রোগ আছে যেসব রোগীদেরও লিভারে জমতে পারে অতিরিক্ত চর্বি। যেমন ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে বাড়তি চর্বি, হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপারটেনশন, ক্রনিক হেপাটাইটিস সি, পলিসিস্টিক ওভারি ইত্যাদি। এছাড়াও লিভারে চর্বি জমে অতিরিক্ত মদ্যপানে।

কাজেই যখন কোনো ব্যক্তি লিভারে চর্বি বা ফ্যাটি লিভার নিয়ে আমার মতো কোনো লিভারের ডাক্তারের চেম্বারে উপস্থিত হন, তখন আমাদের একটা বড় দায়িত্ব হচ্ছে দেখে নেওয়া যে ওই রোগীটির এসব রোগের কোনোটি আছে কিনা। থাকলে তার চিকিৎসা করাটাও জরুরী।

ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ কী

ফ্যাটি লিভারে তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ নেই। রোগীরা প্রায়ই অল্পতেই ক্লান্তিভাব বা অবসন্নতা, পেটের ডান দিকে, ওপরের দিকে ব্যথা বা অস্বস্তি, পায়খানার অভ্যাসে পরিবর্তন ইত্যাদি সমস্যার কথা বলে থাকেন। তবে এসব লক্ষণ যেহেতু আরো দু-দশটা রোগে থাকতে পারে তাই এ দিয়ে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা কঠিন। বেশিরভাগ রোগী পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো জানতে পারেন যে, তাদের লিভার অতিরিক্ত চর্বি বা ফ্যাটি লিভার আছে।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা কী

ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে ধন্বন্তরি চিকিৎসা হচ্ছে লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন বা যাপিত জীবনযাত্রার পরিবর্তন। রাতের বেলা গপ্পসপ্প সেরে, টকশো দেখে দেরিতে খেয়ে সোজা বিছানায় না যেয়ে বরং, আগে খেয়ে তারপর অন্য কাজ সেরে খাওয়ার দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরে ঘুমাতে যাওয়াটা স্বাস্থ্যসম্মত। ঠিক যেমন স্বাস্থ্যসম্মত অপ্রয়োজনীয় শর্করা যেমন চায়ে চিনি, মিষ্টি ইত্যাদি বাদ দেওয়া। আর গরু-খাসি, ফাস্ট ফুড-ফ্যাটি ফুড যে বর্জনীয় সেটা তো বলাই বাহুল্য। সাথে সপ্তাহে পাঁচ দিন আধা ঘণ্টা করে হাঁটার অভ্যাসটা দারুণ ভালো।

মনে রাখতে হবে, কেউ যদি শরীরের ওজন দশ শতাংশ কমাতে পারেন তবে তার লিভারে চর্বি কমে যায় প্রায় অর্ধেক। দেখা যায় যেসব ফ্যাটি লিভার রোগী অসচেতন, তারা আর দশ জন লিভার রোগীর চেয়ে আগে মৃত্যুবরণ করে। কারণ চর্বি যে শুধু লিভারে জমে তা তো নয়। চর্বি জমে হার্ট আর ব্রেনেও। আর বাড়তি চর্বি বাড়ায় ক্যান্সারের ঝুকিও। অন্যদিকে লিভারে ফ্যাট আছে জেনে যারা সতর্ক হয়ে যান, তারা সাধারণত দীর্ঘ, সুস্থ জীবনের অধিকারী হন।

ফ্যাটি লিভারের ওষুধ আছে কি না

এই প্রশ্নের উত্তরটা একই সাথে হ্যাঁ এবং না। এখন এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে যেগুলো লিভারে চর্বি কমায় আর লিভারকে ভালো রাখে। এই তালিকায় যেমন আছে ভিটামিন ই অথবা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, তেমনি আছে হালের রেজমেটেরন, সারোগ্লিটাজার, ওবিটাকলিক অ্যাসিড আর সিমাগ্লুটাইড। এই ওষুধগুলো মূলত অন্য রোগের ওষুধ হলেও, এগুলো ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় যথেষ্ট কার্যকরী বলে প্রমাণিত হচ্ছে। আমরা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় লাইফ স্টাইল মডিফিকেশনের পাশাপাশি ওষুধও ব্যবহার করে থাকি, কারণ দেখা যায় বই-পুস্তকে যা-ই লেখা থাকুক না কেন শুধু খাদ্যাভাস আর জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে ফ্যাটি লিভার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যেমন আমাদের বেশিরভাগ পরিবারেই একই রান্নাঘরে একই ধরনের খাবার রান্না করা হয়। কাজেই কাউকে যদি বলা হয় শুধু তার জন্য আলাদা ধরনের খাবার রান্না করতে, বাস্তবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তরকারি বারবার গরম করলে তাতে তরকারিতে যে তেল ব্যবহার করা হয় তা ট্রান্সফ্যাটিঅ্যাসিডে পরিণত হয়। এতে লিভারে চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ে, অথচ বেলায়-বেলায় রান্না করা তো আর সম্ভব নয়। আর এও দেখা গেছে যে, যেসব ব্যক্তি অনেক চেষ্টায় কমিয়ে আনতে পারেন তাদের মধ্যে দশ শতাংশ সেই ওজনটা ধরে রাখতে পারেন না। কিছুদিন পর আবার যেই কার সেই!

শেষ কথা

মোদ্দা কথা ফ্যাটি লিভার, লিভারের একটি রোগ যা বড় অঘটন ঘটাতে পারে। এটি যেমন ঠিক, তেমনি সময়মতো ধরা পড়লে আর ব্যবস্থা নিলে ফ্যাটি লিভার যে নিরাময়যোগ্য তাও কিন্তু একই রকম ঠিক। কাজেই এরপর যখন পরিচিত কেউ আলট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে লিভারে চর্বির রিপোর্ট নিয়ে ঘরে ফিরবেন তখন তাকে আতঙ্কিত কিংবা উদাসীন না হয়ে বরং সচেতন হবার পরামর্শটুকু দেবেন। পরামর্শ দেবেন একজন লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার, কারণ এতেই মঙ্গল।


অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
এমবিবিএস, এমএসসি (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি)(লন্ডন), এমডি (হেপাটোলজি)
এফআইসিপি, এফআরসিপি (আয়ারল্যান্ড), এফআরসিপি (লন্ডন)
এফবাস, পিএইচডি (ইউনিভার্সিটি অব মালয়া)
অর্ডার, কার্লোস জে. ফিনলে (কিউবা)
ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ভিজিটিং প্রফেসর, ঐতা ইউনিভার্সিটি, জাপান
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp