বাড়ছে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি

বাড়ছে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি

অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমান

আমাদের দেহের প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—যকৃৎ বা লিভার। শরীর থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে এবং বিপাকীয় কার্যক্রম পরিচালনায় লিভারের সুস্থতা অনেক জরুরি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে কিছু অভ্যাস, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ভাইরাসের সংক্রমণে লিভারে সৃষ্টি হয় নানা রোগ। তেমনই এক জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ—লিভার সিরোসিস।

বাড়ছে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি

লিভার সিরোসিস কী

লিভার সিরোসিস এমন একটি রোগ যে রোগে লিভারের কোষগুলো শক্ত হয়ে ছোট ছোট দানার মতো হয়ে যায়। লিভারের স্বাভাবিক গঠন বা আকৃতি পরিবর্তন হয়। লিভারে তৈরি হয় সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিস। ধীরে ধীরে এটি বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে লিভার সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে এর কার্যক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

লিভার সিরোসিস কেন হয়

লিভার সিরোসিসের বিভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণ : লিভার সিরোসিসের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণ। এই দুই ভাইরাল হেপাটাইটিস সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর শরীরে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ফলে ভাইরাস দীর্ঘদিন শরীরে নীরবে থেকে যায় এবং এক পর্যায়ে রোগী সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

বাড়ছে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি

ফ্যাটি লিভার : শরীরের ওজন বৃদ্ধি পেলে বা অতিরিক্ত চর্বি জমলে এর প্রভাব লিভারেও পড়ে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও অলস জীবনযাপনের কারণে চর্বি জমে ফ্যাটি লিভার হয়। একে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারও বলে।
ফ্যাটি লিভার থেকে সৃষ্ট নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস বা ন্যাশ লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

মদ্যপানজনিত ফ্যাটি লিভার : অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেও লিভারে চর্বি জমে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। একে মদ্যপানজনিত বা অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার বলে। মদ্যপানের কারণে ফ্যাটি লিভার থেকে হয় মদ্যপানজনিত হেপাটাইটিস, যা উন্নত বিশ্বে লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ।

অন্যান্য : অটোইমিউন হেপাটাইটিস, শরীরে অতিরিক্ত আয়রন বা হেমাটোক্রোমাসিস, বিরল রোগ উইলসন ডিজিজ, দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও লিভার সিরোসিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

লিভার সিরোসিসের ধরন ও লক্ষণ

লিভার সিরোসিস ২ ধরনের।

১. কমপেনসেটেড লিভার সিরোসিস : কমপেনসেটেড সিরোসিসে লিভারের অল্প কিছু কোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং ফাইব্রোসিসের মাত্রা কম থাকে। এক্ষেত্রে লিভারের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকে এবং রোগীর দেহে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পেটের ডান পাশে হালকা ব্যথা ও পেট ভারী ভারী লাগার মতো উপসর্গ হতে পারে।

২. ডিকমপেনসেটেড লিভার সিরোসিস : ডিকমপেনসেটেড সিরোসিসে লিভারের কার্যক্ষমতা লোপ পায় এবং রোগীর দেহে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন—

বাড়ছে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি
  • চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ জন্ডিস।
  • খাবারে অরুচি।
  • পেটে পানি আসা।
  • অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত অনুভব করা।
  • জ্বর জ্বর অনুভূতি।
  • প্রস্রাব কম হওয়া।
  • মলত্যাগে সমস্যা।
  • রক্তবমি।
  • মেজাজ খিটখিটে থাকা।
  • অতিরিক্ত চুল পড়া।
  • শরীরের রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
  • স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ও এলোমেলো কথাবার্তা বলা।

চিকিৎসা ও প্রতিকার

কমপেনসেটেড লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে মূলত ঠিক কী কারণে সিরোসিস হয়েছে, সেটি নির্ণয় করে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন— হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকলে সম্পূর্ণ বিশ্রাম, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ও ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে রোগীকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের ওপর অধিক জোর দিতে হবে। অন্যদিকে ডিকমপেনসেটেড লিভার সিরোসিসের ক্ষেত্রে লিভার যেহেতু পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায় সেহেতু লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন বা প্রতিস্থাপনই এর একমাত্র চিকিৎসা।

লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে করণীয়

  • সঠিক সময়ে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা নিশ্চিত করুন।
  • স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার খান এবং নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • শরীরে কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত কি না, তা পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।
  • হেপাটাইটিস পরীক্ষা না করে অন্যের রক্ত গ্রহণ করবেন না।
  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
  • অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন।
  • যেসব ওষুধ লিভারের ক্ষতি করতে পারে, চিকিৎসকের পরামর্শে সেগুলো সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।

ডা. সেলিমুর রহমান

অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমান
এমবিবিএস (ঢাকা), এফসিপিএস (মেডিসিন),
এফআরসিপি (আইআরই), এফআরসিপি (এডিন)
ফেলোশিপ ইন লিভার ডিজিজেস অ্যান্ড এন্ডোস্কপি (জাপান)
অধ্যাপক, লিভার বিভাগ (প্রাক্তন)
ইউজিসি অধ্যাপক ও কোর্স ডাইরেক্টর, মেডিসিন অনুষদ (প্রাক্তন)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।

LinkedIn
Share
WhatsApp