বিয়ের আগে স্বাস্থ্যপরীক্ষা কেন জরুরি

শুধু নারী নয়, বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে পুরুষের ক্ষেত্রেও। যৌনবাহিত সংক্রামক রোগের বাহক হতে পারেন নারী ও পুরুষ যে কেউ। বংশপরম্পরায় ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ও এপিলেন্সি থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেও এসব রোগের ঝুঁকি থাকে। মা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশু অন্ধ হয়ে জন্মাতে পারে। এমন নানাবিধ শারীরিক জটিলতা খুব সহজে এড়ানো যায় বিয়ের আগেই সচেতন হলে। এতে যেমন বিয়ের পর সঙ্গীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়, তেমনি নিজের অসুস্থতা শনাক্ত হলে পরিপূর্ণ চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেও ভালো থাকা যায়। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রজন্মকেও রাখা যায় সুরক্ষিত।

অবহেলায় বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি, স্বাস্থ্যপরীক্ষা না করালে কী কী ঝুঁকি আছে

  • মা-বাবা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • বাবা মায়ের রক্তের গ্রুপ জটিলতায় সন্তান প্রাণঘাতী জন্ডিস নিয়ে জন্ম নিতে পারে।
  • নারী হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের বাহক হলে পুরুষ সঙ্গী ও গর্ভের সন্তান এতে সংক্রমিত হয়।
  • পুরুষের শুক্রাণু সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে কিংবা নারীর ওভারিতে কোনো জটিলতা থাকলে সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা তৈরি হয়।
  • নারী-পুরুষ যেকোনো একজন সিফিলিস, গনোরিয়া ও এইডসের মতো যৌনবাহিত রোগের বাহক হলে সঙ্গী সংক্রমিত হতে পারে।
  • মা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশু অন্ধ হয়ে জন্মাতে পারে। তাছাড়া গনোরিয়া নারীর বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ।
  • বংশপরম্পরায় ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ও এপিলেন্সি থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেও এসব রোগের ঝুঁকি থাকে।

কী কী স্বাস্থ্যপরীক্ষা অতি জরুরি

ফার্টিলিটি টেস্ট : নারী ও পুরুষ—বন্ধ্যা হতে পারেন যে কেউ। তাই বিয়ের আগেই পুরুষের সিমেন অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে শুক্রাণুর সংখ্যা জেনে নেওয়া জরুরি। ওভুলেশন টেস্ট করে নারী জেনে নিতে পারেন ডিম্বাশয়ের পরিস্থিতি। ইউরেটাসে কোনো সমস্যা থাকলে বিয়ের আগেই তা নির্ণয় করে সুচিকিৎসা গ্রহণ করুন। প্রজননসংক্রান্ত জটিলতা নির্ণয়ে নারী ও পুরুষ উভয়েই আলট্রাসনোগ্রাফি অব পেলভিক অর্গান টেস্টের মাধ্যমে সার্বিক অবস্থা জেনে নিতে পারেন।

এসটিডি টেস্ট : এসটিডি হলো যৌনবাহিত সংক্রমণ রোগ। যৌন মিলনের মাধ্যেম সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দেহে ছড়াতে পারে সিফিলিস-গনোরিয়া, এইচআইভি এইডসসহ নানা রোগ। যৌনবাহিত রোগের মধ্যে কিছু আছে যার ভাইরাস গর্ভাবস্থায় সন্তানের দেহেও প্রবেশ করতে পারে। এতে সন্তান জন্ম নেয় এসব রোগের বাহক হয়ে। তাই বিয়ের আগে প্রি-ম্যারিটাল হেলথ স্ক্রিনিং করিয়ে নিলে ঝুঁকি এড়ানো যায়। ভিডিআরএল পরীক্ষার মাধ্যমে খুব দ্রুত সিফিলিস শনাক্ত করা যায়। আর এইচআইভি এবি ১ এবং এইচআইভি এবি ১১ পরীক্ষার মাধ্যমে এইডস রোগ নির্ণয় করা যায়। রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমেই অধিকাংশ যৌনবাহিত সংক্রামক রোগগুলো শনাক্ত করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া : থ্যালাসেমিয়া একটি জিনবাহিত রক্তরোগ। স্বামী-স্ত্রী দুজনই এই রোগের বাহক হলে সন্তান এতে সংক্রমিত হয়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। তখন বোনম্যারো প্রতিস্থাপন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই ঝুঁকি এড়াতে বিয়ের আগে সিবিসি টেস্ট করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ জেনে নিন।

হেপাটাইটিস : নারী হেপাটাইটিসের বাহক হলে যৌন মিলনের মাধ্যমে পুরুষ সঙ্গী সংক্রমিত হতে পারে। তা ছাড়া গর্ভের সন্তানও এই ভাইরাসের বাহক হয়ে জন্ম নিতে পারে। এইচবিএসএজি, অ্যান্টি এইচএভি আইজিএম, অ্যান্টি এইচইভি আইজিএম এবং অ্যান্টি এইচসিভি পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে হেপাটাইটিস শনাক্ত করা যায়।

রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা : স্ত্রীর রক্ত নেগেটিভ গ্রুপের এবং স্বামীর রক্ত পজিটিভ গ্রুপের হলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে প্রথম সন্তান যদি নেগেটিভ গ্রুপের হয় তাহলে ভয়ের কিছু নেই। বিপত্তি বাধে প্রথম সন্তানের রক্ত পজিটিভ গ্রুপের হলে। নেগেটিভ-পজিটিভ মিথস্ক্রিয়ায় মায়ের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এতে মা এবং শিশু উভয়ের শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে প্রথম সন্তান জন্মের পরপরই মায়ের শরীরে অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন দিলে উপকার পাওয়া যায়।

মানসিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা : অল্পতেই রেগে যাওয়া, অতিরিক্ত সন্দেহ করা কিংবা সারাক্ষণ বিষণ্ন থাকার ফলে তৈরি হতে পারে তীব্র পারিবারিক কলহ। তা ছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হলে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আসতে পারে অনীহা। এসব অপ্রত্যাশিত কলহ এড়াতে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী উভয়ের মানসিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে নেওয়া দাম্পত্যজীবনের জন্য ভালো।

দীর্ঘমেয়াদি ও জিনগত রোগ নির্ণয় : ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও এপিলেন্সির মতো নানা রকম রোগব্যাধি বংশপরম্পরায় বাসা বাঁধতে পারে শরীরে। তাই সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচতে সতর্ক থাকা জরুরি। বিয়ের আগেই পাত্র-পাত্রী নিজেদের ও পারিবারিক রোগের ইতিহাস জেনে নিলে সুস্থ ও সুন্দর পারিবারিক জীবন পেতে পারেন।


ডা. যুথী ভৌমিক

এমবিবিএস, এফসিপিএস (গাইনি অ্যান্ড অবস্)
এফসিপিএস (রিপ্রোডাকটিভ এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি)
ডিপ্লোমা ইন আইভিএফ অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিন (জার্মানি)
ট্রেনিং ইন আইভিএফ (চেন্নাই, ইন্ডিয়া)
প্রসূতি, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp