বুক জ্বালাপোড়ার কারণ, জিইআরডি :প্রতিরোধে করণীয়

বুক জ্বালাপোড়ার কারণ, জিইআরডি :প্রতিরোধে করণীয়

ডা. সরকার মোহাম্মদ সাজ্জাদ

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হই। তেমনই এক পরিচিত ও অত্যন্ত অস্বস্তিকর সমস্যা বুক জ্বালাপোড়া। বিভিন্ন কারণে গলা-বুক জ্বালা করলেও এর প্রধান কারণ জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ। শুরুতে খুব একটা মারাত্মক মনে না হলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যা শরীরে বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসকের পরামর্শে জিইআরডি নিয়ন্ত্রণে সচেতন হওয়া জরুরি।

জিইআরডি কী

আমাদের দেহে খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলে লোয়ার ইসোফেজিয়াল স্ফিংটার নামক একটি ভালভ রয়েছে। এই ভালভের কাজ হলো সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যনালি থেকে খাদ্যদ্রব্যকে পাকস্থলীতে নিয়ে যাওয়া এবং পাকস্থলীতে খাদ্য হজমের জন্য যে অ্যাসিড, পেপসিন ও পিত্তরস উৎপন্ন হয় তা খাদ্যনালিতে আসতে বাধা দেওয়া। কিন্তু কোনো কারণে এই স্ফিংটার ভালভের কার্যক্রম ব্যাহত হলে পাকস্থলীতে থাকা অ্যাসিডমিশ্রিত খাদ্য পুনরায় খাদ্যনালি হয়ে আমাদের গলা পর্যন্ত উঠে আসে। তখন গলা জ্বালা বা বুক জ্বালার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। একে অ্যাসিড রিফ্লাক্স বলে। সপ্তাহে যদি ২ বার বা তার বেশি অ্যাসিড রিফ্লাক্স হয় তখন এই সমস্যাকে গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা জিইআরডি বলা হয়।

কেন হয়

জিইআরডি-এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো— হায়াটাস হার্নিয়া। ডায়াফ্রাম নামক পর্দা দ্বারা আমাদের বুক থেকে পেট আলাদা থাকে। হায়াটাস হার্নিয়া হলে পাকস্থলীর অংশবিশেষ ডায়াফ্রাম থেকে ওপরে উঠে যায় বা বুকের ভেতরে ঢুকে যায়। ফলে পাকস্থলী থেকে অ্যাসিড খাদ্যনালিতে চলে আসে এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা বুক জ্বালার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে। এছাড়া আরও যেসব কারণে জিইআরডি হতে পারে সেগুলো হলো—

  • ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার খাওয়া।
  • প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে খাওয়া।
  • অতিরিক্ত চা, কফি পান করা।
  • অত্যধিক ধূমপান ও মদ্যপান করা।
  • রাতে ঘুমানোর আগে ফাস্ট ফুড বা মসলাদার খাবার খাওয়া।
  • খাবার খাওয়ার পর পরই ঘুমাতে যাওয়া ও চিত হয়ে ঘুমানো।
  • স্থূলতা ও গর্ভাবস্থা।
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
  • অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রভৃতি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

লক্ষণ ও উপসর্গ

জিইআরডির লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • পেট, বুক ও গলা জ্বালা করা।
  • বুকে ব্যথা।
  • বমিভাব বা বমি।
  • শুকনো কাশি হওয়া।
  • দীর্ঘস্থায়ী গলাব্যথা।
  • মুখে টক বা তিতা স্বাদ অনুভূত হওয়া।
  • পেট ফোলা ও পেটের ওপরের দিকে মৃদু ব্যথা অনুভব করা।
  • গলায় কিছু আটকে থাকার মতো অনুভূত হওয়া।
  • টক ঢেকুর ওঠা।
  • কণ্ঠস্বর ভারী ও কর্কশ হয়ে যাওয়া।

জিইআরডি-এর কারণে বুক জ্বালাপোড়া ও হার্ট অ্যাটাক এক নয়

গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ ও হার্ট অ্যাটাক উভয় ক্ষেত্রেই বুক জ্বালা ও বুক ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়। এতে অনেকেই রোগ দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন না। ফলে অনেক সময় হার্ট অ্যাটাককে অ্যাসিড রিফ্লাক্স আবার অ্যাসিড রিফ্লাক্সকে হার্ট অ্যাটাক মনে করে বিভ্রান্ত হন। এতে চিকিৎসা বিলম্বিত হয় এবং জীবন সংশয় দেখা দেয়। এজন্য জিইআরডি ও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।
সাধারণত জিইআরডি-এর ক্ষেত্রে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালিতে উঠে আসার কারণে পেট, বুক ও গলায় অস্বস্তিকর জ্বালাপোড়া বা ব্যথাসহ উপরোল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়। অন্যদিকে আমাদের দেহের করোনারি ধমনি যখন হৃৎপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তখন হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাকের কারণে গলা-বুক জ্বালাপোড়ার সঙ্গে বুকে ব্যথা, বুকে চাপ লাগা, কাঁধ, পিঠ, ঘাড় এবং চোয়ালে ব্যথা, ঘাম, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, উদ্বেগ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। সুতরাং এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

জিইআরডি নিয়ন্ত্রণে করণীয়

গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আবশ্যক। এজন্য—

  • একবারে ভরপেট না খেয়ে অল্প করে বারবার খান।
  • খাবার খাওয়ার সময় অতিরিক্ত পানি পান করবেন না।
  • চা, কফি, কোল্ড ড্রিংকস, চিপস, চকলেটসহ যেসব তৈলাক্ত ও মসলাযুক্ত খাবার এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় সেগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
  • খাবার খাওয়ার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পর ঘুমাতে যান।
  • বেশি আঁটসাঁট পোশাক না পরে ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরুন।
  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • দুশ্চিন্তামুক্ত ও হাসিখুশি থাকুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টাসিড, ওমিপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, র‍্যাবিপ্রাজল ওষুধগুলোর যেকোনো একটি সেবন করতে পারেন। এগুলো পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিডের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

ডা. সরকার মোহাম্মদ সাজ্জাদ
এমবিবিএস, এমআরসিপি (লন্ডন), এফসিপিএস (মেডিসিন), এফসিপিএস (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি)
সহকারী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ,
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, শাহবাগ, ঢাকা
মেডিসিন, ডায়াবেটিস, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড লি, (ডায়াগনস্টিক), মিরপুর

LinkedIn
Share
WhatsApp