ভাইরাল হেপাটাইটিস : লিভারের প্রদাহজনিত রোগ

ভাইরাল হেপাটাইটিস : লিভারের প্রদাহজনিত রোগ

অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ

লিভার বা যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হলো— ভাইরাসের সংক্রমণ বা ভাইরাল হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস— এ, বি, সি, ডি এবং ই— প্রধানত এই ৫ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণে ভাইরাল হেপাটাইটিস হয়। যে কোনো বয়সের মানুষ ভাইরাল হেপাটাইটিস এ বা ই দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। হেপাটাইটিস এ, ই দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায় ও স্বল্প মেয়াদি লিভার প্রদাহ করে থাকে। প্রাপ্তবয়ষ্করা এ রোগে আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ ওঠেন। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। হেপাটাইটিস বি, সি, ডি দ্বারা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহ হয়।

ভাইরাল হেপাটাইটিস যেভাবে ছড়ায়

হেপাটাইটিস— এ ও ই দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস—বি ও সি রক্ত, দেহনিঃসৃত অন্যান্য তরল পদার্থ, একই সিরিঞ্জ বা সুইয়ের মাধ্যমে মাদক বা ওষুধ গ্রহণ, জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্রপাতি দিয়ে শরীরে কোনো অস্ত্রোপচার— এসবের মাধ্যমে দেহে সংক্রমিত হয়। এছাড়া, হেপাটাইটিস- বি ও সিতে আক্রান্ত গর্ভবতী মা থেকে শিশুর মধ্যেও এই ভাইরাস ছড়ায়। অনেক সময় হেপাটাইটিস ভাইরাস বিশেষ করে হেপাটাইটিস— বি ও সি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে শরীরে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ভাইরাস দীর্ঘদিন শরীরে নীরবে থেকে যায় এবং এক পর্যায়ে লিভারের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে। এজন্য হেপাটাইটিস— বি ও সি কে বলা হয় নীরব ঘাতক।

অপরদিকে হেপাটাইটিস-ডি ডেল্টা হেপাটাইটিস (এইচডিভি) নামে পরিচিত। ইতিমধ্যেই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে হেপাটাইটিস ‘ডি’ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর, সর্দি, কাশি বা ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে আরও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন—

  • খাবারে অরুচি।
  • বমিভাব বা বমি।
  • পেটের ওপরের অংশে ব্যথা।
  • মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।
  • ত্বকে চুলকানি।
  • অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করা।
  • হাতের তালু, চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস।
  • প্রস্রাবের রং হলুদ হওয়া।
  • মলের রং পরিবর্তন।

হেপাটাইটিস নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

সাধারণত, রক্তের বিলিরুবিন ও লিভারে বিদ্যমান এনজাইম— এসজিপিটি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় রোগী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত কি না। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে রক্তে বিলিরুবিন ও এসজিপিটি’র মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়া, কোন ভাইরাসের সংক্রমণে হেপাটাইটিস হয়েছে সেটা জানতে রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি। পরবর্তী সময়ে রোগের তীব্রতা অনুযায়ী আলট্রাসনোগ্রাফি, এন্ডোস্কপিসহ অন্যান্য পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসাপদ্ধতি

কোনো ব্যক্তি যখন প্রথমবার ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন তখন তাকে অ্যাকিউট হেপাটাইটিস বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাকিউট বা স্বল্পমেয়াদি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে রেখেই সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের পর রোগীকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সময় বাড়িতে তৈরি স্বাভাবিক ও সুষম খাবার খাওয়া ভালো।

যদি অতিরিক্ত বমি হয় এবং রোগী মুখে খাবার খেতে না পারে, সেক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে ও শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে। অ্যাকিউট হেপাটাইটিসে আক্রান্ত শতকরা ৯০ ভাগ রোগী তিন সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে, এক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শনাক্ত হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

হেপাটাইটিস ভাইরাস যদি ৬ মাসেরও বেশি সময় শরীরে থাকে তখন তাকে ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বলা হয়। ভাইরাল হেপাটাইটিস বি ও সির সংক্রমণে ক্রনিক হেপাটাইটিস হয়। দীর্ঘমেয়াদি এই হেপাটাইটিসের কারণে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যার জন্য লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধে করণীয়

যে কোনো রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। হেপাটাইটিসও প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু সচেতনতা অবলম্বন করা যায়। এজন্য—

  • সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন।
  • স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান।
  • খাবার তৈরির সময় হাত ও খাবারের পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন।
  • খাওয়ার আগে ও শৌচাগার ব্যবহারের পরে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করুন।
  • বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
  • অন্যের ব্যবহৃত সুই, সিরিঞ্জ, টুথব্রাশ, ব্লেড ও রেজর ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • হেপাটাইটিস পরীক্ষা না করে অন্যের রক্ত গ্রহণ করবেন না।
  • হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষা করুন। আক্রান্ত হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
  • শিরাপথে মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন।
  • সঠিক সময়ে হেপাটাইটিস-এ ও বি ভাইরাসের টিকা নিশ্চিত করুন।

অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ

অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ
এমবিবিএস (ডিএমসি), এমডি (হেপাটোলজি)
এফআরসিপি (লন্ডন)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লিভার বিভাগ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ
চেম্বার: ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিক)

LinkedIn
Share
WhatsApp