শিশু ও বয়স্কদের ডায়াবেটিস : কখন করবেন পরীক্ষা

ডায়াবেটিস যেকোনো বয়সে হতে পারে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী কিংবা পুরুষ—যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। শিশুদের ডায়াবেটিসে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেলেও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে শুরুতে কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। দীর্ঘ সময় ডায়াবেটিস চিকিৎসাবিহীন থাকলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ও চোখের সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা জেনে সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিলে এবং জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে ডায়াবেটিস সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস সাধারণত বড়দের রোগ হলেও শিশুরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। অনেকেই মনে করেন, বড়দের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয় এবং শিশুদের হয় টাইপ- ১। তবে এই কথা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

শিশুদের ডায়াবেটিস

সাধারণত শিশুরা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়। এর ব্যতিক্রমও আছে। মানুষের শরীরের অগ্ন্যাশয় নামক গ্রন্থির বিটা সেল থেকে ইনসুলিন তৈরি হয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে অটোইমিউন ও অন্যান্য কারণে বিটা সেল ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি তৈরি হয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা দ্রুত ওজন হ্রাস, উচ্চতা না বাড়া ও বারবার শরীরে ইনফেকশন হওয়ার পাশাপাশি অনেক সময় এক ধরনের ডায়াবেটিক ইমার্জেন্সি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, যাকে ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস বলে। অন্যদিকে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শারীরিক ব্যায়াম ও খেলাধুলার অভাবে শিশুদের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে বেড়ে যাচ্ছে শিশুদের মাঝে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রবণতা।

প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিস

বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর শরীরে কোনো লক্ষণ থাকে না। তাই অনেক টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী চিকিৎসার আওতার বাইরে থাকে। অনেক রোগী দীর্ঘকালীন ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জানতে পারেন তাদের ডায়াবেটিস আছে। যাঁদের ওজন বেশি, কায়িক পরিশ্রম করেন না, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন এবং যাদের পরিবারে ডায়াবেটিসের রোগী আছে— তাঁরাই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন।
ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা

শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যার ওপর ডায়াবেটিসের ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হৃদরোগের (হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিওর) অন্যতম প্রধান কারণ। এটি বাড়িয়ে তুলছে স্ট্রোক, প্যারালাইসিস ও স্নায়ুরোগের ঝুঁকি। কিডনিরোগ ও প্রস্রাবের ইনফেকশন তো আছেই। চোখের ছানি, চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণ এমনকি অন্ধত্বও হতে পারে। প্রতিবছর অনেক ডায়াবেটিসের রোগীর পায়ে ক্ষত বা আলসার এবং গ্যাংগ্রিন হয়, যার জন্য অনেক সময় অ্যাম্পুটেশনও প্রয়োজন হয়।

কখন করবেন পরীক্ষা

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৪০ মিলিয়ন মানুষ জানেন না যে তাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
তাই আসুন জেনে নেওয়া যাক ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো—

  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
  • প্রচণ্ড পিপাসা।
  • বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা।
  • ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া।
  • অতিরিক্ত দুর্বলতা।
  • ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া।
  • হঠাৎ দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন।

যদি কোনো উপসর্গ নাও থাকে, তবুও যাঁরা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদেরও ডায়াবেটিসের স্ক্রিনিং টেস্টগুলো করা উচিত।

কারা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন

  • ওজন বেশি বা স্থূলতা।
  • উচ্চ রক্তচাপ।
  • রক্তে চর্বির আধিক্য।
  • যাদের হৃদরোগ আছে।
  • যাঁরা কায়িক শ্রম করেন না।
  • যাঁদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল।
  • যাঁদের পূর্বে প্রি-ডায়াবেটিস ছিল।
  • যাঁদের মা-বাবা, ভাইবোন বা নিকটাত্মীয় ডায়াবেটিসের রোগী।

ওপরের কোনোটা না থাকলেও যাঁদের বয়স ৩৫ বছর বা তার বেশি, তাঁরাও ডায়াবেটিসের স্ক্রিনিং টেস্ট করবেন। যদি স্ক্রিনিং টেস্টের রিপোর্ট স্বাভাবিক আসে, তাহলে প্রতি ৩ বছর অন্তর অন্তর টেস্ট করতে হবে।

ডায়াবেটিস শনাক্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (ওজিটিটি) :

ডায়াবেটিস শনাক্তের পরীক্ষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি এটি। সাধারণত সকালে খালি পেটে (কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা খালি পেটে থাকতে হয়) একবার রক্ত দিতে হয়। তারপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ (বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ডোজ একটু ভিন্ন) মিশ্রিত পানি খাবার ২ ঘণ্টা পর আবার রক্ত পরীক্ষা করে শর্করার মাত্রা নির্ণয় করা হয়। আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন (এডিএ) -এর গাইডলাইন অনুযায়ী, খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা ৭.০ মিলিমোল বা তার বেশি ও গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি— এর দুইটি বা যেকোনো একটি হলে ডায়াবেটিস রোগটি নির্ণয় হয়। আবার খালি পেটে ৫.৬-৬.৯ মিলিমোল অথবা ২ ঘণ্টা পর ৭.৮- ১১.০ মিলিমোল হলে তাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলা হয়। এর চেয়ে কম থাকলে ডায়াবেটিস নেই।

এইচ বি ওয়ান সি টেস্ট : এই পরীক্ষার জন্য খালি পেটে থাকা লাগে না। যেকোনো সময় এই পরীক্ষা করা যায়। এটা দিয়ে রক্তে বিগত কয়েক মাসের শর্করার গড় বোঝা যায়। এইচ বি ওয়ান সি- মাত্রা ৬.৫% বা তার বেশি হলে তা ডায়াবেটিস আছে নির্দেশ করে। অন্যদিকে যদি ৫.৭-৬.৪% আসে, তাহলে প্রি-ডায়াবেটিস আছে ধরে নেওয়া হয়।

র‌্যানডম ব্লাড সুগার টেস্ট : দিনের যেকোনো সময় এই পরীক্ষা করা যায়। খালি পেটে থাকতে হয় না। তবে ওজিটিটি এবং এইচ বি ওয়ান সি টেস্ট থেকে এর গুরুত্ব কম। যদি রোগীর ডায়াবেটিস এর ক্লাসিক্যাল লক্ষণগুলো থাকে এবং র‌্যানডম ব্লাড সুগার ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি আসে তাহলে রোগীর ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়।

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটা ও শারীরিক ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে ডায়াবেটিস সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শুধু প্রয়োজন সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা। মনে রাখবেন, একজন ডায়াবেটিস রোগীও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

আসুন সবাই ডায়াবেটিসের লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হই এবং সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে এর সুচিকিৎসা গ্রহণ করি।


ডা. সুষমিতা পাল

এমবিবিএস, গোল্ড মেডেলিস্ট (ঢামেক)
এমডি, (গোল্ড মেডেলিস্ট) এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম
বিসিএস (স্বাস্থ্য)
কনসালট্যান্ট, এন্ডোক্রাইনোলজি
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড লি. (ডায়াগনস্টিকস), কলাবাগান

LinkedIn
Share
WhatsApp