শিশু-কিশোরের ঘুমের সমস্যা
প্রফেসর ডা. এম এ মোহিত কামাল
শিশুর ঘুমের সমস্যা নিয়ে অনেক মা-বাবাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। কোনো কোনো নবজাতক কিংবা ছোট শিশু সহজে ঘুমিয়ে যায়। আবার কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে ঘুমের ঘাটতি দেখা যায় ঘাটতি এতই চরমে পৌঁছায় যে, অস্থির হয়ে পড়েন মা-বাবা। অসহনীয় হয়ে ওঠে তাঁদের জীবনযাপন। কৈশোরে ঘুমের মাত্রা এত বেশি থাকে যে সন্তানকে সময়মতো স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকেরা হিমশিম খেয়ে যান। ঢুলুঢুলু চোখে টিনএজাররা কিছু না খেয়েই ভোরে স্কুলের পথে পা বাড়ায়। আবার ব্যতিক্রমও রয়েছে।
ঘুমের সমস্যার কারণে শিশু-কিশোরের আচরণে ঘটে বিরাট পরিবর্তন। কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অপর্যাপ্ত ঘুম টিনএজারদের মেজাজ, আচরণ ও পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বড়দের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, অনিদ্রার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হয়, শিক্ষণ ও স্মরণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কগনিশনে বা চিন্তনের জট পাকায়, ধোঁয়াশার কারণে পরিচ্ছন্ন বাস্তব ধারণা তৈরি হতে পারে না। চিন্তনের সমস্যা থেকে দেখা দেয় দৈহিক ও মানসিক উপসর্গ।
নবজাতক ও ইনফ্যান্সিতে ঘুমের মাত্রা বেশি থাকে, বয়সের ধাপে ধাপে কমে আসে ঘুমের মাত্রা।
কেন এমনটি হয়
এ নিয়েও গবেষণা হয়েছে প্রচুর। কয়েকটি গবেষণাপত্রের সারাংশ নিচে তুলে ধরা হলো :
আগের চেয়ে বর্তমানে ঘুমের সমস্যার ব্যাপকতা ও গভীরতা নিয়ে আরও বেশি জানা যাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের ঘুমের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার হার অনেক বেশি। সমস্যার ব্যাপকতা আগের অভিজ্ঞতা ও ধারণাকে হার মানিয়েছে।
বলা হচ্ছে, অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে দিনের বেলায় আলস্য বেড়ে যায়, মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, ঘুমজড়ানো কিংবা ঘুমকাতুরে ভাব বজায় থাকে। ফলে আচরণেও পরিবর্তন আসে, বিপর্যয় আসে। স্থায়ী ঘুমের সমস্যা বজায় থাকলে ইতিবাচক আবেগ সহজে জাগে না। কিছু ভালো লাগে না, বিরক্তি কিংবা নেতিবাচক আবেগের জালে জড়িয়ে কাটে দিন। রাতও হয়ে ওঠে অসহনীয়।
দীর্ঘদিনের ঘুমের সমস্যার কারণে শিশু-কিশোরের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুম কিংবা নির্ঘুমের কারণে ‘জিনের’ পরিবর্তন ঘটে। ফলে মস্তিষ্কে সার্কিট (Circuty) বিকাশে সমস্যা হয়।
মস্তিষ্কের যে অংশ ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশই মনোযোগ শাসন করে, ধরে রাখে। অতি দুরন্ত শিশু, যারা এডিএইচডি বা মনোযোগের ঘাটতিজনিত অতি সক্রিয় দুরন্তপনায় ভোগে, তাদের ঘুমের সমস্যা হয় বেশি।
ঘুমের সমস্যা থেকেই কি তৈরি হয় মনোযোগের ঘাটতি
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যথাযথ উত্তর পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, নির্ঘুম বা অপর্যাপ্ত ঘুমই প্রধানত এর জন্য দায়ী। কিন্তু মা-বাবাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, এডিএইচডি রোগে শিশুদের ঘুমের সমস্যার আলাদা কোনো স্থায়ী ধরন পাওয়া যায়নি। এদেরও ঘুমের সূচনায় সমস্যা হয়। সহজে ঘুম আসে না কিংবা ঘুমের মধ্যে অস্থিরতা থাকে অথবা সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় (ওয়েনস্ট, ২০০০)।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে ঘুম
নতুনভাবে জানা যাচ্ছে, কৈশোরে হরমোন নিঃসরণের কারণে ঘুমের ওপর প্রভাব পড়ে। ঘুমের চক্রে পরিবর্তন আসে। দেরিতে ঘুম আসা, দেরিতে ওঠার প্রধান কারণ হচ্ছে, বয়ঃসন্ধিক্ষণে চক্রটির স্বাভাবিক ধারা বদলে যাওয়া। দেরিতে ঘুমালেও টিনএজারদের দেরিতে ওঠার সুযোগ নেই। ভোরবেলায় ঠেলেঠুলে মা-বাবা তুলে দেন। সর্বোচ্চ ৯ ঘণ্টায় পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। দীর্ঘদিন এ ধরনের অবস্থা চলতে থাকলে টিনএজারদের আচরণ প্রভাবিত হয়, বিদ্যালয়ের দক্ষতা কমে যায়। এভাবে দীর্ঘদিনব্যাপী ঘুমের ওপর বাধা বা হামলা এলে শিশু-কিশোরের অ্যালার্টনেস বা সচেতন স্তরে বিপর্যয় নেমে আসে। ফলে জখম হয় মানসিকতা। মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। দুর্বল হয়ে যায় স্মৃতিশক্তি। এ ধরনের পরিবর্তনের কারণে শিশুর পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে কিংবা দৈহিক জখমের আশঙ্কা বেড়ে যায় (ডাহল, ২০০২)।
টিনএজারদের ঘুমের এ চক্রটির ব্যাপারে মা-বাবার জানা থাকা জরুরি। নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমে সন্তানের বয়ঃসন্ধিক্ষণের এ ধরনের সমস্যা এবং বিপর্যয় রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয় এবং ক্ষতির মাত্রা কমানো যায়।
প্রফেসর ডা. এম এ মোহিত কামাল
এমবিবিএস, এম.ফিল. (সাইকি), এফসিপিএস (সাইকিয়াট্রি)
অধ্যাপক, সাইকোথেরাপি
সিনিয়র-চিফ কনসালট্যান্ট (সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড সাইকোথেরাপি)
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল
সাবেক প্রধান, সাইকোথেরাপি
প্রাক্তন একাডেমিক কোর্স ডিরেক্টর এমডি (সাইকিয়াট্রি)
সাবেক পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা