হৃদ্‌রোগ : দ্রুত শনাক্তের অভাবে বাড়ছে জটিলতা

বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদ্‌রোগ। দীর্ঘদিনের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি কারণে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় হৃদ্‌রোগের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেলেও অবহেলার কারণে তা সঠিক সময়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। অথচ, যেকোনো রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে তা নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এজন্য হৃদ্‌রোগের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে বা যাঁদের এ রোগের ঝুঁকি রয়েছে, তাঁদের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা।

হৃদ্‌রোগের ধরন

মূলত হৃৎপিণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন যেকোনো রোগই হৃদ্‌রোগ। হৃদ্‌রোগের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন—.

করোনারি হার্ট ডিজিজ : নানা কারণে হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে ধমনিগুলো পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তনালিগুলো হৃৎপিণ্ডে প্রয়োজনীয় রক্ত, অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে না। এই সমস্যাটিকেই বলা হয় করোনারি হার্ট ডিজিজ বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ। এ রোগে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।

হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনজনিত জটিলতা বা কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া : প্রতি মিনিটে আমাদের হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক স্পন্দনের মাত্রা হলো ৬০ থেকে ১০০। এই মাত্রা ৬০-এর কম কিংবা ১০০-এর বেশি হলে হৃৎস্পন্দনের ছন্দপতন হয় তাকে বলা হয় কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া। বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা এবং চোখে ঝাপসা দেখা কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়ার লক্ষণ।

কার্ডিওমায়োপ্যাথি : এ রোগে হৃৎপিণ্ডের পেশিগুলো অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল ও পাতলা হয়ে যায়, একে ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি বলে। অথবা পেশিগুলো পুরু হয়ে শক্ত হয়ে যায়, একে হাইপারটোপিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি বলে। এর ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং হৃদ্‌যন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বুকে চাপ ও ব্যথা অনুভূত হওয়া, ক্লান্তি ও অবসাদ, পা ও পায়ের পাতায় পানি আসা কার্ডিওমায়োপ্যাথির লক্ষণ।

হার্ট অ্যাটাক : কোনো কারণে হৃৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই ব্যাপারটিই হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকের প্রধান উপসর্গ হচ্ছে বুকে ব্যথা। ব্যথা মৃদুভাবে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে হাত ও ঘাড়সহ অন্যান্য অঙ্গে। সেই সঙ্গে বুকে চাপ লাগার মতো অনুভূতি হয়।

হার্ট ফেইলিওর : নানা কারণে হৃৎপিণ্ড যখন দুর্বল হয়ে যায় এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হারায় তখন হার্ট ফেইলিওরের মতো সমস্যা দেখা দেয়। হার্ট ফেইলিওরের প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। এছাড়া এ অবস্থায় ঝিমঝিম ভাব হয়, নখ ও ঠোঁট নীল হয়ে যায় এবং এক সময় মনে হয় দম শেষ হয়ে আসছে।

জন্মগত হৃদ্‌রোগ : কিছু শিশু জন্ম থেকেই হৃৎপিণ্ডের সমস্যায় ভুগে থাকে। একে জন্মগত হৃদরোগ বলে।

কারণ

হৃদ্‌রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন—

  • পরিবারের কারো হৃদ্‌রোগ থাকলে, অন্য সদস্যদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
  • অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমার কারণে হৃদ্‌রোগ হতে পারে।
  • অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস যেমন— অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, কাঁচা লবণ, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার অভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম না করা, স্থূলতা এবং অপর্যাপ্ত ঘুম হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
  • ধূমপান, মদ্যপান, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হৃদ্‌রোগের অন্যতম কারণ।

হৃদ্‌রোগ নিয়ন্ত্রণে জরুরি কিছু স্বাস্থ্যপরীক্ষা

রক্তচাপ : উচ্চরক্তচাপ হৃদরোগের অন্যতম কারণ। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

লিপিড প্রোফাইল : কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য খারাপ চর্বিজাতীয় উপাদানের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা জানতে এই পরীক্ষাটি করা জরুরি। রক্তে চর্বিজাতীয় উপাদানের মাত্রা ঠিক থাকলে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমে।

এইচবিএ১সি : রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত এইচবিএ১সি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কেননা হৃদ্‌রোগের অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস।

ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) : এ পদ্ধতিতে হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ বৈদ্যুতিকভাবে নিরূপণ করা হয় এবং গ্রাফ বা চিত্রের মাধ্যমে তা ধারণ করা হয়। ইসিজির মাধ্যমে হৃৎস্পন্দনের গতি ও ছন্দ বিশ্লেষণ করা হয় এবং হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া বা হৃৎপিণ্ডের অন্যান্য সমস্যা চিহ্নিত করা যায়।

ইকোকার্ডিওগ্রাম : হৃৎপিণ্ডের আকার, গঠন, ভালভের অবস্থা, রক্ত সঞ্চালনের গতি এবং রক্ত সঞ্চালনক্ষমতা নির্ণয়ে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি।
ইকো কালার ডপলার : হৃদরোগ শনাক্তকরণে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে ভালভ ও প্রকোষ্ঠের বর্তমান অবস্থা এবং হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ ঠিক মতো হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট (ইটিটি) : শারীরিক পরিশ্রম করা অবস্থায় হৃৎপিণ্ডের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ইটিটি করা হয়। পরীক্ষা শুরুর আগে রোগীর শরীরে ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং রোগীকে একটি ট্রেডমিল কিংবা এক্সারসাইজ বাইকে হাঁটতে বা সাইকেল চালাতে বলা হয়। এই অবস্থায় রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন ও ইসিজি পরীক্ষা করা হয় এবং হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা, হৃৎস্পন্দনের হার, রক্তনালিতে কোনো ব্লকের সম্ভাবনা আছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

এক্স-রে : হৃৎপিণ্ডের আকার, করোনারি ধমনি বা অন্যান্য রক্তনালির কোনো সমস্যা এবং হার্ট ফেইলিওর বা অন্য কোনো কারণে ফুসফুসে পানি জমেছে কি না, তা নির্ণয়ে এক্স-রে করা জরুরি।

হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে করণীয়

  • সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
  • অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন।
  • রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • ধূমপান ও মদ্যপানসহ সব ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য এড়িয়ে চলুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। হাসিখুশি ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকুন।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করুন। বুকে ব্যথাসহ হার্টের যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে নিজে নিজে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না। যত দ্রুত সম্ভব একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকুন।

ডা. নুর মোহাম্মদ

ডা. নুর মোহাম্মাদ

এমবিবিএস, ডি-কার্ড
এমসিপিএস, এমডি
মেডিসিন ও হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন ও হৃদ্‌রোগ
চেম্বার : ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা

LinkedIn
Share
WhatsApp