হেপাটাইটিস প্রতিরোধে টিকা
অধ্যাপক ডা. আশরাফুল ইসলাম
টিকা বা ভ্যাকসিন আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যেকোনো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো— টিকা। তেমনই একটি সংক্রামক রোগ হেপাটাইটিস, যে রোগ প্রতিরোধে সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণের বিকল্প নেই। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই এই মোট ৫ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাসের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘বি’ এর টিকা রয়েছে। সঠিক সময়ে টিকাগুলো গ্রহণ করলে সহজেই হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
হেপাটাইটিস কী
লিভার বা যকৃতের সংক্রামক রোগ— হেপাটাইটিস। এটি মূলত একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা যকৃৎ বা লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে। দূষিত খাবার, পানি ও দেহনিঃসৃত বিভিন্ন তরল পদার্থের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ সৃষ্টি করে। যে কোনো বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রাপ্তবয়স্করা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে কয়েক মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেলেও শিশুদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়।

হেপাটাইটিস যেভাবে ছড়ায়
হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ মূলত অস্বাস্থ্যকর খাবার ও দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। নিরাপদ খাবার পানির সংকট এবং পয়োনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা নেই এমন স্থানে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, শৌচাগার ব্যবহারের পর ভালোভাবে হাত না ধোয়া এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। প্রায় সারা বছরই হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেলেও গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ রক্ত ও দেহনিঃসৃত অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে দেহে সংক্রমিত হয়। কোনো গর্ভবতী নারী হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ তে আক্রান্ত হলে গর্ভের শিশুরও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর শরীরে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস প্রবেশ করে মায়ের কাছ থেকে। অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক, একই সিরিঞ্জ বা সুইয়ের মাধ্যমে মাদক বা ওষুধ গ্রহণ, সঠিকভাবে যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে শরীরে ট্যাটু করা, পরীক্ষা না করেই রক্ত নেওয়া— এসব কারণে ভাইরাস দুটি ছড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস দুটি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে সংক্রমণের ২-৩ মাস পর লক্ষণ প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে ভাইরাস লিভারের ক্ষতি করতে শুরু করে এবং একসময় রোগী লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধীরে ধীরে হেপাটাইটিস-ডিতেও আক্রান্ত হন।
হেপাটাইটিসের টিকা
যেকোনো রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। হেপাটাইটিস প্রতিরোধের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি টিকাকরণ। এক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-এ ও বি ভ্যাকসিন হেপাটাইটিস প্রতিরোধে সক্ষম।

হেপাটাইটিস-এ টিকা : হেপাটাইটিস প্রতিরোধে হেপাটাইটিস-এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা শতকরা ৯৫ ভাগ। জন্মের পর ১-২ বছর বয়সের মধ্যে শিশুকে দুই ডোজ হেপাটাইটিস-এ টিকা দিতে হবে। ১ম ডোজ টিকা দেওয়ার ৬ মাস পর ২য় ডোজ টিকা দেওয়া হয়।
তবে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যারা আগে টিকা গ্রহণ করেননি এবং হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তারাও চিকিৎসকের পরামর্শে টিকা নিতে পারবেন।
হেপাটাইটিস-বি টিকা : হেপাটাইটিস-বি প্রাণঘাতী ভাইরাস হলেও টিকার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে ইপিআই ভ্যাকসিন কর্মসূচির আওতায় অন্যান্য রোগের পাশাপাশি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে হেপাটাইটিস-বি টিকা দিতে হবে। তাছাড়া, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের গর্ভজাত শিশুকে হেপাটাইটিস-বি টিকার পাশাপাশি অবশ্যই ইমিউনোগ্লোবিউলিন টিকা দেওয়া জরুরি।
৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুর শরীরে
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস প্রবেশ করে
মায়ের কাছ থেকে।
৭০ বছর বয়স পর্যন্ত যে কেউ এ টিকা নিতে পারেন। ১ম ডোজ টিকা নেওয়ার ১ মাস পর ২য় ডোজ এবং ১ম ডোজ নেওয়ার দিন থেকে ৬ মাস পর ৩য় ডোজ টিকা নিতে হয়। ৩টি ডোজ সম্পন্ন হওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি দেখা যায়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠেনি তাহলে ৫ বছর পর ৪র্থ ডোজ (বুস্টার ডোজ) টিকা নিতে হবে।
গর্ভবতী নারী ও রক্ত পরীক্ষায় এইচবিএসএজি (HBsAg) পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে এমন ব্যক্তি এই টিকা নিতে পারবেন না। এছাড়া ১ম ডোজ টিকা নেওয়ার পর যদি কারো শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাহলে তার আর ২য় ডোজ টিকা দেওয়া হয় না।

অধ্যাপক ডা. আশরাফুল ইসলাম
এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (গ্যাস্ট্রো)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ (প্রাক্তন),
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল