থাইরয়েড সমস্যায় অবহেলা নয়

আমাদের শরীরে মূলত ৮টি হরমোন গ্রন্থি রয়েছে। গ্রন্থিগুলো বিভিন্ন ধরনের হরমোন উৎপাদন ও নিঃসরণের মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় রাখে। তেমনই একটি গ্রন্থি হলো থাইরয়েড। এটি আমাদের গলার সামনের অংশে থাকে। এই গ্রন্থির প্রধান কাজ হলো থাইরয়েড হরমোন তৈরি করা। শরীরের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, শক্তি উৎপাদন এবং শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই হরমোনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হলে থাইরয়েডজনিত নানা সমস্যা ও শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। পুরুষদের তুলনায় নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন।

থাইরয়েড সমস্যায় অবহেলা নয়

থাইরয়েড সমস্যার ধরন ও লক্ষণ

থাইরয়েড সমস্যা কয়েক ধরনের হয়। যেমন—

হাইপোথাইরয়েডিজম : থাইরয়েড গ্রন্থি যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করতে পারে না, তখন এই অবস্থাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। থাইরয়েডের সমস্যাগুলোর মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজমে মানুষ বেশি ভুগে থাকেন। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • ক্লান্তি বা অবসাদ।
  • ঘুম ঘুম ভাব।
  • অকারণে ওজন বেড়ে যাওয়া।
  • হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া।
  • রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
  • শীত সহ্য করতে না পারা।
  • অতিরিক্ত চুল পড়া।
  • রুক্ষ ও শুষ্ক ত্বক।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • মেয়েদের অনিয়মিত পিরিয়ড ও সন্তান ধারণে সমস্যা। শিশু হাবাগোবা হওয়া।
  • গলা ফুলে যাওয়া বা গলগণ্ড।
  • মানসিক বিষণ্নতা ও উদ্বেগ। স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া।

হাইপারথাইরয়েডিজম : থাইরয়েড গ্রন্থিতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপন্ন হলে তাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলো হলো—

  • ওজন কমে যাওয়া।
  • বুক ধড়ফড় করা।
  • গরম সহ্য করতে না পারা।
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
  • পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া।
  • ত্বকে তৈলাক্তভাব।
  • ঘন ঘন মলত্যাগ।
  • হাত-পা কাঁপা।
  • মানসিক অস্থিরতা।

থাইরয়েডাইটিস : থাইরয়েডাইটিস হলো থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ। এই প্রদাহের কারণে গলা ও চোয়ালে ব্যথা হয়, এমনকি গলা ফুলেও যেতে পারে। থাইরয়েডাইটিসের কারণে শরীরে দীর্ঘমেয়াদি হরমোন-ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

গলগণ্ড : থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনের অন্যতম উপাদান আয়োডিন। এর অভাবে গলগণ্ড রোগ হয়। এই রোগে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়। শুরুতে তেমন সমস্যা মনে না হলেও ধীরে ধীরে ফোলা বেড়ে যেতে পারে।

ক্যানসার : থাইরয়েড গ্রন্থির কোষ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে টিউমার বা ক্যানসারও হতে পারে। এক্ষেত্রে, গলায় বা ঘাড়ে চাকা বা ফোলা অনুভব করা, দীর্ঘস্থায়ী গলাব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা এবং কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

ওপরের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাইরয়েডের চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি।

থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা

থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়ে রক্তের টিএসএইচ (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) পরীক্ষা একটি কার্যকর পদ্ধতি। এই পরীক্ষায় শিরা থেকে রক্ত নিয়ে টিএসএইচ-এর মাত্রা পরিমাপ করা হয়। টিএসএইচ হরমোন থাইরয়েড হরমোন থাইরক্সিন (টি৪) ও ট্রাইআয়োডোথাইরনিন (টি৩) উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতি লিটার রক্তে টিএসএইচ-এর স্বাভাবিক মাত্রা ০.৪ থেকে ৪.০ মিলিইউনিট। এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে হাইপোথাইরয়েডিজম এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে হাইপারথাইরয়েডিজম বলা হয়।

থাইরয়েডের ঝুঁকি নির্ণয়ে টিএসএইচ পরীক্ষার পাশাপাশি আরও কিছু স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা জরুরি। যেমন—

বিএমআই : উচ্চতা অনুযায়ী ওজন অতিরিক্ত কম বা বেশি থাইরয়েড সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এজন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বিএমআই নির্ণয় করা জরুরি।

রক্তচাপ : থাইরয়েড সমস্যায় রক্তচাপ কখনো বেড়ে যায় আবার কখনো কমে যায়। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় থাইরয়েডের ঝুঁকি কতটা।

সিবিসি : হিমোগ্লোবিনসহ রক্তের অন্যান্য উপাদানের মাত্রা জানতে সিবিসি পরীক্ষা করা হয়। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রার ভারসাম্যহীনতা এবং রক্তস্বল্পতা থাইরয়েড সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।

রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা : ডায়াবেটিসের কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম ও হাইপারথাইরয়েডিজম উভয় রোগের ঝুঁকিই বেড়ে যায়। এজন্য নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিসসহ থাইরয়েডের ঝুঁকি নির্ণয় করা জরুরি।

এইচবিএসএজি ও এসজিপিটি : লিভারের কোনো রোগ থেকে থাইরয়েড সমস্যার ঝুঁকি রয়েছে কি না তা জানতে এইচবিএসএজি ও এসজিপিটি পরীক্ষা করা হয়।

সিরাম ক্রিয়েটিনিন ও ইউরিন : কিডনির কার্যক্ষমতা নির্ণয়ে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়। কিডনি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ইউরিন পরীক্ষায় প্রোটিন বা অন্যান্য অস্বাভাবিক উপাদান পাওয়া যেতে পারে। থাইরয়েড ও কিডনি একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে।

আলট্রাসনোগ্রাফি : থাইরয়েড গ্রন্থির গঠন ও টিউমার শনাক্তের জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়।

থাইরয়েডের চিকিৎসা

থাইরয়েড সমস্যার ধরনের ওপর ভিত্তি করে এর চিকিৎসা করা হয়। হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে সাধারণত থাইরয়েড হরমোন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে লেভোথাইরক্সিন নামক ওষুধ সবচেয়ে কার্যকর। অপরদিকে হাইপারথাইরয়েডিজমে, থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত মাত্রা নিয়ন্ত্রণে মেথিমাজোল বা প্রোপিলথিউরাসিলের মতো অ্যান্টি-থাইরয়েড ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। থাইরয়েড গ্রন্থিতে গোটা বা নোডিউল হলে চিন্তিত হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই থাইরয়েড গোটায় ক্যানসার পাওয়া যায় না। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য থাইরয়েড বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।


অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ

অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ

এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (মেডিসিন)
এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি, বারডেম)
মেডিসিন, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp