প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ: ধূমপান মানেই ক্ষতিকর

আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর অভ্যাসগুলোর মধ্যে ধূমপান অন্যতম। ধূমপান শুধু একটি বদভ্যাসই নয়, এটি একধরনের নীরব ঘাতক। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ ও ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা জটিল রোগের অন্যতম প্রধান কারণ ধূমপান। যদিও এই বিষয়গুলো প্রায় সবারই জানা, তবুও অনেকেই এটিকে একটি সাধারণ অভ্যাস বলে মনে করেন এবং সহজেই ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। একজন ব্যক্তি যখন ধূমপান করেন, তখন শুধু তিনিই ক্ষতিগ্রস্ত হন না; তাঁর আশপাশের মানুষও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান

ধূমপান মূলত দুই ধরনের—প্রত্যক্ষ ধূমপান ও পরোক্ষ ধূমপান। যখন কোনো ব্যক্তি নিজে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট বা অন্য কোনো তামাকজাত পদার্থের ধোঁয়া সরাসরি গ্রহণ বা পান করেন, তখন তাকে প্রত্যক্ষ ধূমপান বলে। অপরদিকে নিজে ধূমপান না করলেও প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীর আশপাশে থাকার ফলে অধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরেও সিগারেটে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করে এবং প্রায় একই পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে। একেই বলে পরোক্ষ ধূমপান। ইংরেজিতে বলা হয় প্যাসিভ স্মোকিং বা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং।

স্বাস্থ্যের ওপর ধূমপানের প্রভাব

ধূমপান শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ধূমপানের কারণে ফুসফুস ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় নিকোটিনসহ আরও বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা মুখ, গলা, ফুসফুস, পাকস্থলী ও কোলন ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া, হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, যক্ষ্মা, শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া, মানসিক বিষণ্নতা এবং শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বহুগুণে বেড়ে যায় ধূমপানের কারণে।

পরোক্ষ ধূমপানও সরাসরি ধূমপানের মতোই শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সিগারেটের ধোঁয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিশুদের। কারণ, তাদের ফুসফুস এখনো পরিণত হয়নি। আর শিশুর ফুসফুসটি ছোট্ট হলেও পরিণত ফুসফুসের চেয়ে অনেক বেশিবার বাতাস টেনে নেয়। তাই বাতাসের সঙ্গে ক্ষতিকর ধোঁয়াটাও শিশুর ফুসফুস ভরে ফেলে দ্রুত। ফলে ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হৃদ্‌রোগ, অ্যাজমাসহ নানা জটিল রোগে শিশু সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। এছাড়া, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে নারীদের গর্ভধারণজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় পরোক্ষ ধূমপানের কারণে জন্ম নিতে পারে অপরিণত, কম ওজনসম্পন্ন বা বিকলাঙ্গ শিশু। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ফুসফুসের রোগে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপান হৃদ্‌রোগের হার বাড়িয়ে দেয়। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায় প্রায় ২০-৩০ শতাংশ।

ধূমপায়ীদের নিয়মিত যেসব স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা জরুরি

ধূমপানের কারণে শরীরে কোনো রোগ সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা আগে থেকে জানার জন্য ধূমপানে আসক্ত ব্যক্তিদের নিম্নের স্বাস্থ্যপরীক্ষাগুলো করা জরুরি।

বিএমআই : ধূমপানের কারণে শরীরের বিপাকপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ওজন অত্যধিক কমে বা বেড়ে যেতে পারে। স্থূলতা কিংবা অতিরিক্ত কম ওজন নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সুতরাং, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কি না, তা জানতে নির্দিষ্ট সময় পর পর ওজন পরিমাপ ও বিএমআই নির্ণয় করা উচিত।

রক্তচাপ : সিগারেটে থাকা নিকোটিন রক্তনালিকে সংকুচিত করে, যে কারণে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা ও ডায়াবেটিসের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই ধূমপায়ীদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সিবিসি : অনেক সময় ধূমপানের কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিনসহ অন্যান্য উপাদানের মাত্রা কমে যায়। ফলে রক্তস্বল্পতাসহ নানা রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এজন্য রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা নির্ণয়ে সিবিসি পরীক্ষা করা হয়।

লিপিড প্রোফাইল : ধূমপানের কারণে রক্তে কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য চর্বিজাতীয় উপাদানের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই রক্তে চর্বিজাতীয় উপাদান সঠিক মাত্রায় আছে কি না, তা জানতে এই পরীক্ষাটি করা প্রয়োজন।

ইলেকট্রোলাইট : শরীরে ইলেকট্রোলাইট অর্থাৎ সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্লোরাইডসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ ধূমপান। এজন্য ধূমপায়ীদের উচিত নিয়মিত ইলেকট্রোলাইটের মাত্রা পরীক্ষা করা।

ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা : ধূমপানের কারণে কিডনিতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, তা নির্ণয়ে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়।

বিলিরুবিন, এসজিপিটি ও অ্যালকালাইন ফসফেট : ধূমপানের কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। আবার দীর্ঘদিন ধূমপান করলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য লিভার ও হাড়ের অবস্থা জানতে রক্তের বিলিরুবিন, এসজিপিটি ও অ্যালকালাইন ফসফেট পরীক্ষা করা জরুরি।

প্রস্রাব পরীক্ষা : ধূমপানের কারণে শরীরে যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করে, তার জন্য কিডনি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি মূত্রতন্ত্র বা মূত্রনালিতেও সংক্রমণ সৃষ্টি হতে পারে। প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে এ ধরনের যেকোনো জটিলতা শনাক্ত হলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ইসিজি : দীর্ঘদিন ধূমপানের ফলে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে এবং ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদি হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হৃৎপিণ্ডের সার্বিক অবস্থা নির্ণয় করতে ইসিজি করা প্রয়োজন।

আলট্রাসনোগ্রাফি : ধূমপান গ্যাস্ট্রিক আলসার, পিত্তথলিতে পাথর, লিভার ও কিডনির নানা রোগের অন্যতম কারণ। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে আগে থেকেই এসব রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং সচেতন থাকা যায়।

বুকের এক্স-রে : ধূমপায়ীদের অনেকেই নিউমোনিয়া ও শ্বাসনালির সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হন। বুকের এক্স-রে করলে জানা যায়, ফুসফুসে কোনো সংক্রমণ হচ্ছে কি না বা ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কতটা। তাছাড়া, সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ব্রঙ্কাইটিসের উপসর্গও এই পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব।


অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

এমবিবিএস, এফসিসিপি,
এফআরসিপি, পিএইচডি, এফসিপিএস
ফেলো পালমনোলজি স্লিপ মেডিকেল আইসিইউ (সিঙ্গাপুর)
মেডিসিন, বক্ষব্যাধি ও স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

LinkedIn
Share
WhatsApp