অ্যালার্জির নানা ধরন
-অধ্যাপক লে. কর্নেল (অব.) ডা. মোঃ আব্দুল ওয়াহাব
মাস্ক ছাড়া বাইরে গেলেই হাঁচি শুরু হয় রোহানের। গরুর মাংস বা ইলিশ মাছ খেলে শরীরে অসহ্য চুলকানি হয় নীতুর। আবার কিছু কিছু পারফিউম ও লোশন ব্যবহার করলে ত্বকে চুলকানি ও র্যাশ হয় সাব্বিরের। এই প্রতিটি সমস্যাই দেখা দেয় নানা ধরনের অ্যালার্জির কারণে।
অ্যালার্জির কারণ ও ধরন একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। কারো খাবারে, কারো ধুলাবালুতে আবার কারো ঠান্ডায়। এছাড়া অনেকের পোষা প্রাণীর লোম, ফুলের রেণু, সাবান, পারফিউম, লোশন, সিনথেটিক কাপড় প্রভৃতির সংস্পর্শে গেলে দেখা দেয় অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া।
অ্যালার্জি আসলে কী? কেন হয়?
অ্যালার্জি বহু মানুষের কাছে এক অসহনীয় ব্যাধি। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাঁচি, সর্দি, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি হতে পারে। কারো ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া তীব্র না হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে অ্যালার্জি জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। অ্যালার্জির আসলে কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। পৃথিবীর যেকোনো জিনিসই কারো না কারো অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। মূলত আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কোনো কারণে বাঁধাগ্রস্ত হলেই অ্যালার্জির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
সাধারণত আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা সবসময় দেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কখনো কখনো ক্ষতিকর নয় কিন্তু রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা মনে করে এটি ক্ষতিকর—এমন বস্তু প্রবেশ করলেই সে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে আমাদের শরীরে একধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন বলা হয়। অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদানকে বলা হয় অ্যালার্জেন।
একেকজনের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা একেক রকম। তাই ব্যক্তিভেদে অ্যালার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদানও ভিন্ন হয়ে থাকে।
অ্যালার্জির সাধারণ উপসর্গ
- কোনো খাবার খাওয়ার পর ত্বকে চুলকানি
- ত্বকের চামড়া লাল হয়ে ফুলে যাওয়া
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি
- হাঁচি ও সর্দি
- মাথাব্যথা
- পেটে ব্যথা
- বমিভাব বা বমি
- ডায়রিয়া
- শ্বাসকষ্ট
- রক্তচাপ কমে যাওয়া
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
নানা রকম অ্যালার্জি
ত্বকের উপরিভাগে অ্যালার্জির প্রকাশ ঘটলে তা বোঝা যায় এবং সহজেই চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু শ্বাসনালি, খাদ্যনালি বা চোখের মতো স্পর্শকাতর স্থানে হলে সেটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কখনো কখনো এটি মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠতে পারে।
নানা কারণে শরীরের নানা অংশে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। তাই অ্যালার্জির ধরন জেনে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। ত্বকের অত্যন্ত পরিচিত ও সাধারণ অ্যালার্জিক রোগগুলো হচ্ছে—
কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস : সাধারণত গরমে সৃষ্টি হওয়া ঘামের সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এই অ্যালার্জি বেশি হতে দেখা যায়। তাছাড়া ধুলাবালু, হাতঘড়ির ব্যান্ড, নিকেলের গয়না, উল বা কৃত্রিম তন্তুর পোশাক, প্রাণীর লোম, ক্রিম, লোশন, সাবান, কাজল, নেইলপলিশ, সিগারেটের ছাই, কোনো বিশেষ ফুলের রেণু প্রভৃতির সংস্পর্শে এলে এই অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এতে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, ত্বকে চুলকানি, জ্বলুনি ও আক্রান্ত অংশ ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ত্বকের সরাসরি সংস্পর্শে এই অ্যালার্জি হয় বলে একে কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস বলা হয়। এই অ্যালার্জিতে অনেকসময় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় আবার কখনো এক থেকে তিন দিনের মধ্যে দেখা দেয়।
আর্টিকেরিয়া বা হাইভস : সাধারণত কোনো বিশেষ খাবার, ওষুধ বা পোকামাকড়ের কামড় থেকে এই অ্যালার্জি দেখা দেয়। আর্টিকেরিয়ায় ত্বকের ওপরের অংশে প্রদাহ হয়। ত্বকের আক্রান্ত অংশ ফুলে ওঠে এবং প্রচণ্ড চুলকানি হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত এই অ্যালার্জি থাকতে পারে। তখন এটিকে বলা হয় ক্রনিক আর্টিকেরিয়া অ্যালার্জি।
অ্যানজিওইডিমা : ত্বকের গভীরে প্রদাহ হলে তাকে বলা হয় অ্যানজিওইডিমা। অনেকসময় অ্যালার্জি আর্টিকেরিয়া হিসেবে শুরু হয়ে অ্যানজিওইডিমাতে রূপ নিতে পারে। কখনো কখনো এটি গুরুতর হতে পারে। রোগীর চোখ-মুখ ফুলে যেতে পারে, তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
চিকিৎসা
অ্যালার্জির ধরনভেদে প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করে অ্যালার্জির ক্ষেত্রে উপশম পাওয়া সম্ভব। একেকজন মানুষের একেক জিনিসে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যাদের বংশে হাঁপানির সমস্যা আছে, তাদের অ্যালার্জির প্রবণতা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। অ্যালার্জিক কনজাংটিইভাটিস হলে চোখে তীব্র চুলকানি ও চোখ লাল হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। আবার কোনো কিছুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। এমনকি দুশ্চিন্তাতেও কারো কারো অ্যালার্জি হতে পারে। তাই ত্বকের ধরন বুঝে প্রসাধনী ব্যবহার করা এবং অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন হয় এমন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ত্বকের উপরিভাগে দৃশ্যমান অ্যালার্জি ছাড়াও অনেক অ্যালার্জি আছে যা ত্বকের ভেতরে হয়। তাই অ্যালার্জির উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অ্যালার্জি পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। অ্যালার্জি পরীক্ষার পর চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে হবে। এছাড়া যেসব খাবারে অ্যালার্জি বাড়তে পারে সেসব খাবার এড়িয়ে চলা, ধুলোবালিমুক্ত পরিবেশে অবস্থান করা এবং বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি।
অধ্যাপক লে. কর্নেল (অব.) ডা. মোঃ আব্দুল ওয়াহাব
এমবিবিএস, ডিডিভি, এমসিপিএস, এফএসিপি (ইউএসএ)
এফসিপিএস (ডার্মাটোলজি), এফআরসিপি, উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (থাইল্যান্ড)
চর্ম, যৌন, সেক্স, অ্যালার্জি ও কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক (চর্ম ও যৌন ব্যাধি বিভাগ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা
সিনিয়র কনসালট্যান্ট
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল