ওভারিয়ান সিস্ট : লক্ষণ, ধরন ও চিকিৎসা
ডা. সেরাজুম মুনিরা
যেকোনো বয়সী নারীদের মধ্যেই ওভারিয়ান সিস্ট দেখা দিতে পারে। তবে যাঁদের ওজন বেশি, অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও ওভারিয়ান সিস্টের পারিবারিক রোগ ইতিহাস আছে, তাঁরা কিছুটা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কোনো কোনো সিস্টের ক্ষেত্রে ব্যথা বা উপসর্গ কিছুই দেখা যায় না। আবার কিছু সিস্টের ক্ষেত্রে পেটে তীব্র ব্যথাসহ নানা রকম লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
ওভারিয়ান সিস্ট কী
ডিম্বাশয়ে তরলযুক্ত থলির নাম জরায়ু সিস্ট। এসব থলির সংখ্যা হতে পারে এক বা একাধিক। ওভারি থেকে কোনো কারণে ডিম্ব স্ফুটন না হলে অথবা ডিম্ব স্ফুটন হওয়ার পরও ফলিকলগুলো চুপসে বা মিলিয়ে না গেলে সিস্ট তৈরি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সিস্টের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না এবং শরীরেও খুব একটা ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয় না। এগুলো দুই-তিন মাসের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু এমন কিছু সিস্ট আছে, যা থেকে বন্ধ্যাত্ব সমস্যার মতো শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে ওভারিয়ান সিস্টের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন—
- অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও ঋতুস্রাবের সময় মারাত্মক ব্যথা।
- তলপেট ফুলে যাওয়া।
- প্রস্রাবে সমস্যা।
- বমি বমি ভাব।
- ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য।
- পেট ফাঁপা ও বুকে জ্বালাপোড়া।
- কখনো সিস্টের কারণে ওজন বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি সিস্টে ক্যানসার দেখা দেয়, তাহলে ওজন কমে যায়।
ওভারিয়ান সিস্টের ধরন
ফাংশনাল সিস্ট
শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে ডিম্ব স্ফুটন ব্যাহত হয়। ডিম্ব স্ফুটন না হলে ডিম্বাণুর মধ্যে তরল জমে সিস্টের সৃষ্টি হয়। আবার কখনো ডিম্বাণু নিঃসরণের পর ফলিকলগুলো মিলিয়ে না গিয়ে তরলযুক্ত থলির সৃষ্টি করে। এ দুটিকে যথাক্রমে ফলিকুলার ও কর্পাস লুটিয়াম সিস্ট বলা হয়।
পলিসিস্টিক (পিসিওএস) সিস্ট
দীর্ঘদিন ক্রমাগত ডিম্ব স্ফুটন না হলে ফলিকলগুলো ওভারিতে জমতে থাকে এবং তা তরলযুক্ত থলিতে পরিণত হয়। এর সংখ্যা ১০ বা এর বেশি হলে তাকে পলিসিস্টিক ওভারি বলা হয়। এ ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
চকলেট সিস্ট
সাধারণত ওভারিতে মাসিকের রক্ত জমাট বেঁধে যে সিস্ট হয় তাকে চকলেট সিস্ট বলা হয়। এতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এই সিস্ট খুব দ্রুত অপারেশন না করালে পরবর্তী সময়ে বন্ধ্যাত্ব থেকে শুরু করে আরো অনেক রকম সমস্যা করতে পারে।
ডারময়েড সিস্ট
ডারময়েড সিস্ট মূলত একধরনের ওভারিয়ান টিউমার। জরায়ুর কোষ থেকে ডারময়েড সিস্ট তৈরি হয়।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য কোনো জটিলতা নির্ণয়ে আলট্রাসনোগ্রাফি করার সময় চিকিৎসকেরা সিস্ট খুঁজে পেতে পারেন। সিস্টের ধরন যদি ফাংশনাল হয় এবং সিস্টের আকার ৫ সেন্টিমিটারের নিচে থাকলে চিকিৎসক দুই-তিন মাস রোগীকে অবজারভেশনে রাখেন। সাধারণত এ সময়ের মধ্যে ফাংশনাল সিস্ট এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়।
কিন্তু বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলে চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ ও রোগের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হন। যেমন ট্রান্স-ভেজাইনাল আলট্রাসাউন্ড, ল্যাপারোস্কপি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান, ম্যামোগ্রাম ও ব্লাড টেস্ট। সিস্টের আকার খুব বড় হলে প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি যদি একটা সিস্ট বড় হয়ে যায়, তাহলে ম্যালিগনেন্সির আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে কালার ডপলার, আলট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআই করে নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া কিছু টিউমার মার্কার যেমন— CA-125, CA 19-9 ও আলফা-ফেটোপ্রোটিন টেস্ট করেও সিস্টে ক্যানসার শনাক্ত করা যায়।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি
সিস্টের ধরন জটিল হলে সে ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হয়। বর্তমানে ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি অত্যন্ত আধুনিক ও কার্যকর একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে নাভির পাশে ছোট ছোট ছিদ্র করা হয়। তারপর ছিদ্রের ফাঁকা অংশ দিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে সিস্ট বের করে আনা হয়। এতে অতিরিক্ত কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না। ওপেন সার্জারির তুলনায় এ পদ্ধতি খুবই সহজ ও নিরাপদ।
প্রতিরোধে করণীয়
- পরিবারে কারো ওভারিয়ান সিস্ট থাকলে আগে থেকে সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিয়ে করা এবং সন্তান নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ভারসাম্য যেন বজায় থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখুন।
- বডি মাস ইনডেক্স অনুযায়ী শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পরিহার করুন।
- প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় ফলমূল, সবুজ শাকসবজি ও গোটা শস্য রাখুন।
- নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পাশাপাশি সুচিকিৎসা গ্রহণ করুন।
- সিস্টের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. সেরাজুম মুনিরা
এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস (গাইনি এন্ড অবস),
এমসিপিএস (গাইনি এন্ড অবস),
এফসিপিএস (রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি)
অবস্, গাইনি, ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন
প্রাক্তন কনসালট্যান্ট, রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি
ও ইনফার্টিলিটি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
চেম্বার : ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল