কিডনি প্রতিস্থাপন ও বাংলাদেশ

সুস্থ কিডনি অতিরিক্ত পানি, মিনারেল ও বর্জ্য পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয়। যখন কিডনি কার্যকারিতা হারায় তখন ক্ষতিকর বর্জ্য শরীরে জমা হতে থাকে। ফলে রক্তচাপ বাড়ে, শরীরে অতিরিক্ত পানি জমা হয়  এবং শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয় না। তখন রোগীর অকার্যকর কিডনির প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী কিডনি রোগে ভূগছে এবং পরিসংখ্যানে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী Chronic কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে-

১। নেফ্রাইটিস ২। ডায়াবেটিস ও ৩। উচ্চ রক্তচাপ

কিডনি প্রতিস্থাপন

কিডনি প্রতিস্থাপন হলো একজন মানুষের অকার্যকর কিডনির বদলে কোনো সুস্থ মানুষের কিডনি স্থাপন করা। নতুন স্থাপিত কিডনি অকার্যকর  কিডনির বদলে কাজ করতে শুরু করে। নতুন স্থাপিত কিডনির ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পর স্বাভাবিক কিডনির মত বর্জ্য নিঃসরণ শুরু করে।

Chronic Kidney রোগে আক্রান্ত রোগীদের সর্বশেষ চিকিৎসা হচ্ছে ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। যাদের ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন দরকার তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ লোক কোন না কোন ভাবে ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজনের সুবিধা পায়। বাকি ৯০ ভাগ রোগী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর যে ১০ ভাগ রোগী ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজনের সুবিধা পায় তাদের মধ্যে মাত্র ৪ ভাগ কিডনি সংযোজন করতে পারে বাকি ৯৬ ভাগ রোগীকে ডায়ালাইসিস করতে হয়।

কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিছু পরীক্ষা দরকার

রক্ত : গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ অবশ্যই দাতার রক্তের সঙ্গে মিলতে হবে।

এইচ.এল.এ (HLA) ফ্যাক্টর : এটি হচ্ছে হিউম্যান লিউকোসাইট এন্টিজেন যা বংশগতভাবে শ্বেত রক্তকণিকায় থাকে।

কিডনি সংযোজনের ধারণা

  • Living Related Transplantation অর্থাৎ কোন একজন সুস্থ ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে যখন কিডনি দান করেন।
  • Living Unrelated Transplantation অর্থাৎ একজন সুস্থ্য ব্যক্তি যখন কিডনি দান করেন।
  • Cadaver Transplantation অর্থ্যাৎ মৃত ব্যক্তির (Brain Dead)) রোগীর কিডনি যখন দান করা হয়। তবে বাংলাদেশে Cadaver Transplantation এর কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন Brain Dead রোগীর আত্মীয় স্বজনের অজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী, আইসিইউতে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব।

প্রতিস্থাপনের আইন কানুন

১৯৯৯ সালে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। ঐ বছর বাংলাদেশের পার্লামেন্টে মানবদেহের অঙ্গ সংযোজন আইন পাশ হয়। এই আইনে শুধুমাত্র রোগীর রক্ত সম্পর্কীয় নিকট আত্মীয় অর্থ্যাত মা-বাবা আপন ভাইবোন, আপন চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং স্বামী স্ত্রী তার কিডনি দান করতে পারবেন। অনাত্মীয়ের কিডনি দান এই আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ICU তে Brain Dead (জীবন্মৃত) ব্যক্তির কিডনি নিকট আত্মীয়ের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিস্থাপিত করা যাবে। (Cadaver Renal Transplantation)। এই আইনের বিধান অনুযায়ী HIV, Hepatitis, B/C দ্বারা আক্রান্ত রোগীর কিডনি সংযোজন করা যাবে না। বাংলাদেশের কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনীয়। তবে ডোনারের অভাব, ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতির ওষুধের উচ্চ মূল্য এবং Cadaver Renal Transplantation চালু না হওয়ার ফলে কিডনি সংযোজন রোগীর সংখ্যা আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়নি।

কিডনি গ্রহীতার বিষয়ে কিছু প্রসঙ্গিক কথা

গ্রহীতার যদি ischaemic heart disese থাকে তা হলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে হবে।

গ্রহীতার যদি ক্যানসার থাকে তাহলে তার পূর্ণ চিকিৎসার ২ বছর পর কিডনি প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।

কিডনি দাতার বিষয়ে কিছু কথা

  • কিডনি দানে ঝুঁকি কতটুকু এটা অনেকে জানতে চান। দাতাকে তার প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে।
  • কিডনি দাতা হিসাবে কোন ব্যক্তিকে গ্রহণ করার পূর্বে তার পূর্ণাঙ্গ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিতে হবে।
  • কিডনি দাতার যদি ডায়াবেটিস বা ক্যানসার থাকে (দু একটি ক্ষেত্র বাদে) তা হলে তাকে দাতা হিসেবে নেয়া যাবে না।
  • দাতার যদি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে সেক্ষেত্রেও তাকে ডোনার হিসেবে নিতে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

প্রতিস্থাপন পদ্ধতি

যদি জীবিত মানুষের কিডনি পাওয়া যায় তবে দাতা এবং গ্রহীতার অপারেশন একই সময়, পাশাপাশি রুমে করা হয়। এক মেডিকেল টিম দাতার কিডনি কেটে আনে, অন্য মেডিকেল টিম গ্রহীতাকে কিডনি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে। নতুন কিডনির রক্তনালী গ্রহীতার রক্তনালীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। প্রতিস্থাপিত কিডনির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি তার কার্যক্রম শুরু করে।

বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন

এবার যদি আমরা একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম কিডনি সংযোজন শুরু হয় বাংলাদেশে। দেখা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মাত্র ৬ জন রোগীর কিডনি সংযোজন করা হয় এবং ১৯৮২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মাত্র একটি সেন্টার অর্থাৎ BSMMU হাসপাতালে কিডনি সংযোজন হত। বর্তমানে Labaid Specialized Hospital সহ আরো ৮-১০টি সেন্টারে নিয়মিত/অনিয়মিত কিডনি সংযোজিত হচ্ছে। এ যাবৎ বাংলাদেশে কিডনি সংযোজন রোগীর সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আশার কথা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে এখন আর দেশের বাইরে যেতে হয় না। ল্যাবএইডসহ ঢাকার অনেক হাসপাতালেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে নিয়মিত।

সর্তকতা

নতুন কিডনি শরীর যেন প্রত্যাখ্যান না করে সেজন্য ওষুধ খেতে হয়, তেমনি জ্বর, পেটে ব্যথা ও মূত্র তৈরির পরিমাণের দিকেও লক্ষ্য  রাখতে হয়। যদি কোনো সমস্যা হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানাতে হবে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পরেও কিডনি প্রত্যাখান হতে পারে এবং রোগীকে ডায়ালাইসিস করতে হতে পারে। কিডনি দাতা ও কিডনি গ্রহীতার কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয় যাতে তাদের পরবর্তী জীবন বিপদমুক্ত থাকে। যদিও অনেকেই কোন রকম বিপদ ছাড়াই কিডনি দান করতে পারে।


অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম

এমবিবিএস, এমডি (নেফ্রোলজি), এফসিপিএস (মেডিসিন)
ইন্টারনাল মেডিসিন ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

LinkedIn
Share
WhatsApp