কিডনি বিকল ও ডায়ালাইসিস চিকিৎসা
ডায়ালাইসিস কী?
যখন কিডনির কার্যকারিতা ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে এবং কিডনি ৮০-৯০ শতাংশ কর্মক্ষমতা হারায় ও শরীরের অতিরিক্ত পানি ও বর্জ্য পদার্থ কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের করতে পারে না তখন জীবন বাঁচানোর জন্য ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। কিডনি সংযোজন ব্যতিত ডায়ালাইসিসই একমাত্র চিকিৎসা যা একজন কিডনি রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে।
কিভাবে ডায়ালাইসিস সম্পূর্ণ কিডনি বিকল রোগীর জীবন বাঁচায়
এ পদ্ধতিতে রক্ত পরিশোধিত করে রক্তের দূষিত বর্জ্য যেমন, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং শরীরের অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়, রক্তের লবণের তারতম্য রক্ষা করে (সোডিয়াম, পটাশিয়াম বাইকার্বনেট ইত্যাদি)। কিন্তু তারপরও কখনো কখনো একটি স্বাভাবিক কিডনির কার্যকারিতা ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে সম্ভব হয় না। ডায়ালাইসিস রোগীদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে হয়।
কখন একজন কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস এর প্রয়োজন হয়?
যখন কিডনির কার্যকারিতা ৮০-৯০% কমে যায়, তখন কিডনি ওষুধের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত পানি ও দূষিত পদার্থ বের করতে না পারার কারণে রোগীর ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব হওয়া, অবসন্নতা, শরীর ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, শরীরে লবণের তারতম্য হওয়ার কারণে বিভিন্ন উপসর্গ তৈরি হয় এবং রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ সময় ‘ডায়ালাইসিস’ জীবন বাঁচানোর অন্যতম উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়।
ধীরগতির কিডনি বিকল ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব না। তবে তাৎক্ষণিক কিডনি বিকল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অল্প কিছুদিনের ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
সাধারণত দুই ধরনের ডায়ালাইসিস করা হয়
১। হেমোডায়ালাইসিস
২। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস
হেমোডায়ালাইসিস খুবই প্রচলিত একটি ডায়ালাইসিস পদ্ধতি যাতে একটি নকল কিডনি (আর্টিফিশিয়াল কিডনি) ও মেশিনের সাহায্যে শরীরের অতিরিক্ত পানি ও দূষিত বর্জ্য শরীর থেকে বের করা হয় এ পদ্ধতিতে সপ্তাহে সাধারণত ২-৩ বার ৪ ঘণ্টা করে ডায়ালাইসিস করা হয়।
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস একটি অত্যন্ত কার্যকর ডায়ালাইসিস পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি নরম নল পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বিশেষভাবে তৈরি এক ধরনের স্যালাইনের মাধ্যমে রক্তকে পরিশোধিত করা হয়, এ পদ্ধতিতে কোন মেশিনের প্রয়োজন হয় না।
কিভাবে হেমোডায়ালাইসিস করা হয়
সম্পূর্ণরূপে খারাপ হওয়া কিডনি রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটা বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কিডনি রোগীদের কৃত্রিম কিডনির সাহায্যে মেশিনের মাধ্যমে রক্ত বিশুদ্ধ করা হয়।
এ পদ্ধতিতে কৃত্রিম কিডনির মাধ্যমে মেশিনের সাহায্যে প্রতি মিনিটে ২৫০-৩০০ সিসি রক্ত পাম্প করা হয়। এ সময় রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে তার জন্য হেপারিন নামে একটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কৃত্রিম কিডনি যা ডায়ালাইজার নামে পরিচিত, এক ধরনের স্যালাইনের (ডায়ালাইজেট) সাহায্যে রক্তকে পরিশোধিত করে, পরিশোধিত রক্ত পুনরায় মেশিনের সাহায্যে শরীরে প্রবেশ করানো হয়, হেমোডায়ালাইসিস সাধারনত সপ্তাহে ২-৩ বার এবং প্রতিবার ৪ ঘণ্টা করে করা হয়। এখানে প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে শরীরের রক্ত মেশিনে ঢুকিয়ে আবার পরিশোধিত রক্ত শরীরে ঢুকানো হয়? এ জন্য শরীরে ভাসকুলার এক্সেস করে নিতে হয়। সাময়িকভাবে ডায়ালাইসিস এর জন্য ডানদিকের বুকের শিরা, ডানদিকের গলার শিরা অথবা যে কোন দিকের উরুর শিরাতে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে ডায়ালাইসিস করা হয়। এ পদ্ধতিতে বেশিদিন ডায়ালাইসিস সম্ভব হয় না ইনফেকশনের কারনে, তাই দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি হিসাবে বাম হাতের কনুই বরাবর বা কবজি বরাবর শিরা ও ধমনিকে সংযোগ করে একটি পথ তৈরি করা হয় যাকে A-V ফিষ্টুলা বলা হয়। কোন কারণে বাম হাত ফিস্টুলা অনুপযোগী হলে ডান হাতেও করা হয়।
হেমোডায়ালাইসিস কোথায় করা হয়
হেমোডায়ালাইসিস সাধারণত হাসপাতাল বা ডায়ালাইসিস সেন্টারে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সদের সহযোগিতায় করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমান ৫০ টির বেশি হেমোডায়ালাইসিস সেন্টার আছে, তবে খুব অল্প সংখ্যক রোগী বাড়িতে ডায়ালাইসিস মেশিন রেখে ডায়ালাইসিস করে থাকে, এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেকে মনে করে হেমোডায়ালাইসিস যন্ত্রণাদায়ক কিনা। না, শুধুমাত্র ডায়ালাইসিস শুরুর সময় রক্ত টানার জন্য যে সূঁচ ফুটানো হয় সেটুকুর সামান্য ব্যথা রোগী অনুভব করে, ডায়ালাইসিসের ৪ ঘণ্টা সময় রোগী বিশ্রাম নিয়ে, ঘুমিয়ে, গান শুনে বা টিভি দেখে পার করতে পারে। ডায়ালাইসিস চলাকালীন সময়ে রোগীদের হালকা খাবার ও পানীয় পান করতে বলা হয়। হেমোডায়ালাইসিস একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলেও এর সুবিধা ও অসুবিধা দুই’ই রয়েছে।
হেমোডায়ালাইসিস এর সুবিধা সমূহ
- হেমোডায়ালাইসিস সাধারণত বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স দ্বারা করানো হয় বলে রোগীর জন্য আরামদায়ক হয়
- এ পদ্ধতিতে শরীরের অতিরিক্ত পানি ও দূষিত বর্জ্য তাড়াতাড়ি বের করা সম্ভব
- সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাইসিস করার কারণে বাকি দিনগুলো রোগীরা মুক্তভাবে চলতে পারে
- ইনফেকশন হওয়ার সম্ভবনা কম
- পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস এর তুলানায় খরচ কম
- একটা সেন্টার একই সময় অনেক রোগীর ডায়ালাইসিস হওয়ার কারণে একই ধরনের রোগীদের দেখা হয়, পরস্পরের সাথে কথা বিনিময় হয় এতে তাদের কিছুটা হলেও মনের ভার লাঘব হয়।
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস
সম্পূর্ণ কিডনি বিকল হওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য এটি বহুল ব্যবহৃত একটি ডায়ালাইসিস পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বাড়িতে বসেই ডায়ালাইসিস নেওয়া যায়, কোন মেশিন বা ডায়ালাইসিস সেন্টারে রোগীকে যেতে হয় না। যে কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে হেমোডায়ালাইসিস এর কোন সুযোগ নেই, সে সব জায়গায় রোগীরা এ পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস এক ধরণের বিশেষ স্যালাইন পেটের মধ্যে দিয়ে রক্ত বিশুদ্ধ করা হয়। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস সাধারণত ৩ ধরণের
১। আইপিডি (ইন্টারমিনেন্ট পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস)
২। সিএপিডি (কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুল্যাটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস)
৩। সিসিপিডি (কন্টিনিউয়াস সাইক্লিং পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস)
স্থায়ী কিডনি বিকল রোগীদের কিডনি প্রতিস্থাপন হলো সর্বোত্তম চিকিৎসা। কিন্তু বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না বিভিন্ন কারণে। তাই বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে ডায়ালাইসিস চিকিৎসা রোগীর জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থা, কি কারণে কিডনি বিকল হয়েছে, তার সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, ডায়ালাইসিস সেন্টার এর সহজলভ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন রোগীর জন্য ডায়ালাইসিস এর কোন পদ্ধতি উপযোগী।
অধ্যাপক ডা. আছিয়া খানম
এমবিবিএস, এমডি (নেফ্রোলজি)
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।