কিশোরীদের যত টিকা
ডা. শারমিন আফরোজ
কোনো রোগ হওয়ার পরে আমরা চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি। কিন্তু চিকিৎসা পর্যন্ত যেতেই হবে না যদি আমরা আগে থেকেই সেই রোগ প্রতিরোধ করার শক্তি অর্জন করি। আর যেকোনো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো— টিকা বা ভ্যাকসিন। টিকা আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নবজাতক শিশু, গর্ভবতী মায়ের পাশাপাশি কিশোরীস্বাস্থ্যে টিকার কোনো বিকল্প নেই। আজ যে কিশোরী, ভবিষ্যতে সেই হবে মা। তাকে সুরক্ষিত রাখা এবং তার শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। না হলে একদিন দেখা যাবে, সে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে ভুগছে বা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিচ্ছে। তাই, কিশোরীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সচেতনতা জরুরি।
কিশোরীদের যেসব টিকা দেওয়া হয়
টিটেনাস টক্সয়েড
ক্লোস্ট্রিডিয়াম টিটানি নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগ হয়। শরীরের কোনো অংশে কেটে গেলে সেই কাটা অংশ দিয়ে এই ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করে এবং টিটানু স্পাসমিন নামক জীবাণু তৈরি করে। জীবাণুটি স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। ফলে শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়। সময়মতো চিকিৎসা না করালে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। টিটেনাসের সংক্রমণ রোধ করতে টিটেনাস টক্সয়েড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ১৫-৪৯ বছর বয়সের মধ্যে সকল মেয়ের টিটি টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক। টিটি টিকা মোট ৫ বার দেওয়া হয়।
টিটি ১ম ডোজ : ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর।
টিটি ২য় ডোজ : ১ম ডোজ দেওয়ার ৪ সপ্তাহ পর।
টিটি ৩য় ডোজ : ২য় ডোজ দেওয়ার ৬ মাস পর।
টিটি ৪র্থ ডোজ : ৩য় ডোজ দেওয়ার ১ বছর পর।
টিটি ৫ম ডোজ : ৪র্থ ডোজ দেওয়ার ১ বছর পর।
টিটেনাস টিকা একই সঙ্গে টিটেনাস, ডিফথেরিয়া ও পারটুসিস বা হুপিং কাশি (Tdap) প্রতিরোধে কার্যকর।
এমআর
হাম ও রুবেলা প্রতিরোধী টিকা এমআর। হাম ভাইরাসজনিত মারাত্মক একটি সংক্রামক রোগ। হাম হলে খিঁচুনি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এমনকি মস্তিষ্কে প্রদাহের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, রুবেলাও ভাইরাসজনিত মারাত্মক একটি রোগ। গর্ভাবস্থার ৩ মাসের মধ্যে কোনো নারী যদি রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে তাঁর গর্ভপাত হতে পারে, গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে এবং শিশু জন্মগত হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য বিয়ের আগেই একজন মেয়ের হাম ও রুবেলা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি। ১৫ বছর বয়সে ১ম ডোজ টিটেনাস টিকার সাথে ১ ডোজ এমআর টিকা দেওয়া হয়। পরে আরও ১ ডোজ এমআর টিকা নেওয়া লাগতে পারে।
এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) খুবই ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস। সাধারণত, অনিরাপদ যৌন মিলনের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায়। এটির সংক্রমণে শরীরের যেকোনো অংশে বিশেষ করে যৌনাঙ্গে আঁচিল, মেয়েদের জরায়ুমুখে ক্যানসার, কণ্ঠনালি ও জিহ্বায় ক্যানসার হয়। এইচপিভি ভাইরাসের কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে এর টিকা রয়েছে, যা এই ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্তের হার প্রায় ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি টিকার মাধ্যমে। ১০ বছর বয়স থেকে মেয়েদের এই টিকা দেওয়া হয়।
১ম ডোজ : ১০-১৫ বছর বয়সে।
২য় ডোজ : ১ম ডোজ দেওয়ার ৬ মাস বা ১ বছরের মধ্যে।
১৫ বছর বয়সের পরে টিকা নিলে ৩ ডোজ টিকা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ১ম টিকা দেওয়ার ১-২ মাসের মধ্যে ২য় টিকা এবং পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে ৩য় টিকা নিতে হবে। এইচপিভি টিকা সাধারণত ১০-২৬ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া হয়। ২৬ বছরের পরে টিকা নেওয়ার প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মেনিনগোকক্কাল ভ্যাকসিন
মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কের আবরণ মেনিনজেসের প্রদাহজনিত সংক্রামক রোগ মেনিনজাইটিস। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে এ রোগ ছড়ায়। শিশু ও ১৬-২৩ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। মেনিনগোকক্কাল ভ্যাকসিন গ্রুপ-এ, সি, ডব্লিউ-১৩৫ এবং ওয়াই মেনিনজাইটিস প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়। কিশোরীদের মেনিনগোকক্কাল এসিডব্লিউওয়াই (Men ACWY) টিকার ২টি ডোজ প্রয়োজন।
প্রথম ডোজ : ১১ বা ১২ বছর বয়সে।
দ্বিতীয় (বুস্টার) ডোজ : ১৬ বছর বয়সে।.
ফ্লু ভ্যাকসিন
শ্বাসতন্ত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়। ফ্লু হলে জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এমনকি নিউমোনিয়ার মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ফ্লু প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো— প্রতিবছর ফ্লু ভ্যাকসিন নেওয়া। ৬ মাস বয়সের পর থেকেই এই ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। কিশোরী মেয়ে যাদের শ্বাসকষ্ট ও হৃৎপিণ্ডের কোনো রোগ রয়েছে এবং দীর্ঘদিন অ্যাসপিরিন থেরাপি নিচ্ছে, তাদের প্রতিবছর ফ্লু ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত।
হেপাটাইটিস-বি
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সংক্রমণে লিভার ক্যানসার ও লিভার সিরোসিসের মতো মারাত্মক রোগ হয়। কোনো নারীর শরীরে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস থাকলে পরে তাঁর সন্তানও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কাজেই গর্ভধারণের আগেই একজন মেয়ের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ১৮ বছরের বেশি বয়সী সকল নারী হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস টিকা গ্রহণ করতে পারবেন। এই টিকার মোট ৩টি ডোজ দেওয়া হয়। ১ম বার টিকা নেওয়ার ১ মাস পরে ২য় ডোজ ও তার পরবর্তী ৬ মাস পরে ৩য় ডোজ টিকা নিতে হবে।
ডা. শারমিন আফরোজ
এমবিবিএস, এমসিপিএস (গাইনি অ্যান্ড অবস্)
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও ল্যাপারোস্কোপিক
ট্রেইনিং ইন ল্যাপারোস্কোপি (ইন্ডিয়া)
হিস্টেরোস্কপি, বন্ধ্যাত্ব গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও
হরমোনের স মস্যা এবং স্তনের সমস্যায় অভিজ্ঞ,
ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিকস, মিরপুর